পলাশ আহসান
লেখাটা শুরু করতে চাই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে। ওই নির্বাচনে পাঁচ জন ভোট কর্মী বাসে চেপে এবং হেঁটে দুদিন ধরে এমন একটি বুথে গিয়েছিলেন, যেখানে মাত্র একজন ভোটার ছিলেন। উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের ওই ভোটকেন্দ্রের একাকী ভোটার ছিলেন একজন ৩৯ বছর বয়সী নারী। ভারতীয় নির্বাচনে ভোটারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে গণমাধ্যমের কাছে গল্পটি বলেছিলেন ভারতের নির্বাচন কমিশনার রাজিব কুমার। এবারও নির্বাচনের আগে রাজিব কুমার ঘোষণা দেন “ভারতের প্রতিটি কোনায় গণতন্ত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য” সারা দেশে ১৫ লক্ষ ভোট কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। “একজন ভোটার জঙ্গলে বাস করুন অথবা বরফ ঘোরা পাহাড়ে, নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছবেন। তারা ঘোড়, হাতি বা খচ্চরের পিঠে চেপেও যেমন যাবে, তেমনি হেলিকপ্টারেও যাবেন। কারণ ‘প্রত্যেক ভোটারই গুরুত্বপূর্ণ।’
ভোট নেয়ার ব্যাপারে এমন দৃঢ় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে এবার ভারতের সাত দফার নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬৪ কোটি ২০ লাখের বেশি। ভোটার ছিলেন প্রায় ৯৭ কোটি। ভোটার উপস্থিতির দিক দিয়ে এটা বিশ্ব রেকর্ড কিন্তু ভোট পড়ার শতকারা হার বিবেচনা করলে বলতে হবে এর চেয়ে বেশি ভোট ভারতীয় নির্বাচনে পড়েছে। শতকারা হারে এবার ভারতের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬৫ ভাগ। তবু নির্বাচন করে উচ্ছ্বসিত রাজিব। তার উচ্ছ্বাস নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই বরং ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি অভিবাদন আছে। কারণ তাদের নির্বাচন পদ্ধতি ভোট দেয়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ উৎসাহ দেয়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে যাদের, তাদের বাড়িতে গিয়েও ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা রাখে নির্বাচন কমিশন।
এই লেখার শিরোনাম দিতে চেয়েছিলাম ভারতের নির্বাচনে “আসলে জয় হয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের” আমি জানি এমন শিরোনাম দেখে অনেকেই বলতেন এটা বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু ভারতের নির্বাচন নিয়ে একজন সাংবাদিক হিসাবে এর চেয়ে শক্তপোক্ত শিরানাম আর পাচ্ছিলাম না। কারণ সাংবাদিক হলেও দিন শেষে আমি একজন বাংলাদেশিও। যে কারণে এমন অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখে আমি খানিকটা ঈর্ষান্বিত। বলা যায়, সেই ঈর্ষা থেকেই এমন শিরোনাম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষমেষ দেখলাম নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে তো সম্মান জানিয়েছে সেদেশের বেশিরভাগ মানুষ। তারা ঘর ছেড়ে বের হয়ে তাদের রায় জানিয়েছেন। বহু আসনে প্রথম দ্বিতীয় এমনকী চতুর্থ প্রার্থী পর্যন্ত ভোটের পার্থক্য বেশ কম। ভোটারদের কারণে কোন এলাকায় প্রচলিত এবং সমীকরণ বদলে গেছে। যে কারণে বুথ ফেরত জরিপও বহু জায়গায় ফলেনি। তাই দিন শেষে সমস্ত সাফল্য আমি ভারতীয় ভোটারদের দিতে চাইলাম এবং শিরোনামটা বদলে দিলাম।
একটু আগে ভারতের নির্বাচন নিয়ে আমার ঈর্ষার কথা বলিছিলাম। কেন হবে না বলুন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমাদের নির্বাচনেও ভোট পড়েছিল শত কারা ৮৯ভাগ। তার আগের প্রায় সব নির্বাচনেই বিপুল অংশগ্রহণ থাকতো ভোটারের। আমাদের ভোটাররাও বদলে দিতেন বহু চির চেনা ছক। কিন্ত ২০০৮ এর পর থেকে সেই ছকটিই বদলে গেলো। অনেকে বলেন সরকারের অনমনীয়তাই এর জন্যে দায়ী। চাইলেই তাদের দাবি অনুযায়ী তত্বাবধায়ক সরকার এনে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে পারতো সরকার। তাই তাদের সেই মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি। আজকের ভারতের দীর্ঘ সফল নির্বাচন করতে কিন্তু কোথাও গণতন্ত্র বন্ধক দিতে হয়নি। তাই কোন গণতান্ত্রিক সরকার যদি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় সেই সুযোগ তাদের দেয়া উচিত। পাশাপাশি সরকারের কাছে জানতে চাওয়া উচিত, কেন তারা তত্বাবধায়কের পথে হাঁটতে চায় না। প্রশ্ন করা উচিত তত্বাবধায়কের ইতিহাস কতটুকু গণতান্ত্রিক?
ভারতের তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশে ১০ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি বুথে সফল নির্বাচন করে ফেলেলা। এর মধ্যে মাত্র ৩৯টি কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচন হয়েছে। ৭ দফার নির্বাচনে মারা গেছে মাত্র একজন। সেই অর্থে সহিংসতা হয়নি বললেই চলে। এরকম একটি নির্বাচনে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধুবাদ না দিলে তাদের প্রতি অবিচার হবে। অথচ আমাদের দেশের নির্বাচনে অংশই নিচ্ছে না কয়েকটি রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের ব্যাপারে “না” তাদের খুব প্রিয় শব্দ। কেন নির্বাচনে আসছে না? সেটা কতটুকু যৌক্তিক? সে আলোচনা এই লেখায় করতে চাই না। বলতে চাই ভারতীয় নির্বাচনে কী অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করলেন, কেন করলেনে এবং কেন নির্বাচনে “না” বললেন না।
শুরুতে নির্বাচন কমিশন নিয়ে আসি। সাধারণত একজন সরকারি এবং একজন বিরোধী দলের প্রতিনিধি এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মিলিয়ে হয় ভারতীয় নির্বচন কমিশন। এখানে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়া নিয়ে খোদ বিচার বিভাগের সঙ্গেই একদফা ঠাণ্ডা লড়াই হয়ে যায় সরকারের। এরপর তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে একজন কমিশনার পদত্যাগ করেন। মাত্র চার দিনের মধ্যে সরকার দুই কমিশনারের নাম ঘোষণা করে। এর পরপরই আসে সাত দফা ভোটের তফসিল। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন বাদ দিলে এত দিন ধরে ভোট আর কখনো হয়নি। এবার ভারতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে এতদিন ধরে কেন নির্বাচন? এনিয়ে তেড়ে ফুড়ে সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা। ভোটারদের সামনে নানাভাবে সেই বিরোধিতা ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কেউ ভোটের মাঠ ছেড়ে যাননি । নির্বাচনকে ‘না’ বলেননি।
ভোট পর্ব শুরুর সময়েই ইভিএম নিয়ে বিরোধীদের মামলা সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল। সেই বিতর্কেরও অবসান হয়নি। আদালতের রায়ে সবগুলো আসনেই নির্বাচন হয়েছে ইভিএমএ। ইভিএমে কারচুপি নিয়ে বিরোধী মহলের সন্দেহ ও শঙ্কা সব সময় ছিল। এবার তাদের পাহাড়, জঙ্গল এবং বরফের মধ্যে ভোটকেন্দ্রেও ইভিএম ছিল। কিন্তু নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ইভিএম নিয়ে কোন গোলযোগ শুনিনি। এর আগে ইভিএমএ নির্বাচন করলে নির্বাচনে যাবেন না, এমন ঘোষণাও কেউ দেননি। অথচ আমাদের নির্বাচনে আমরা ইভিএমএ যাই আবার ফিরে আসি। বিরোধীরা গলার ফাটিয়ে বলতে থাকেন, আগে থেকে ভোট ভরা থাকবে ইভিএমএ। আসলে ইভিএম নিয়ে আমাদের বনের বাঘে খায় না, খায় মনের বাঘে।
যাই হোক শত প্রশ্নের মধ্যেও নির্বাচন হলো। মানুষের রায়ও কিন্তু এরই মধ্যে বুঝতে পেরেছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। সেই বিশ্লেষণে আমি যেতে চাই না। আমার বক্তব্য হচ্ছে ভারতের সব রাজনৈতিক দল বোঝে গণতন্ত্রে নির্বাচনের বিকল্প নেই। গণতন্ত্র মানলে নির্বাচন মানতে হবে। নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্ন ছিল আজ নিশ্চয়ই সেসব প্রশ্ন জনপ্রতিনিধিরা লোকসভায় তুলতে পারবেন। যার যার পছন্দ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। সরকারি দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন। এভাবেই এগিয়ে যাবে ভারেতের গণতন্ত্র। ভারতের প্রতিটি ভোটারও সেই সরল সত্যটি বোঝেন।
কিন্তু আমাদের নির্বাচনের দিকে তাকালে রীতিমত লজ্জা লাগে। নির্বাচন বিরোধীদের নির্বাচনে না যাওয়ার সবচেয়ে সভ্য পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচনকে না বলুন লিফলেট বিতরণ। এর আগে ভোটকেন্দ্রে আগুন, বাসে আগুনের মত নাশকতামূলক কর্মসূচিও ছিল। একটি সরল প্রশ্ন এর আগে অনেকবার করেছি সেটা হচ্ছে নির্বাচন ছাড়া রাজনীতি করার উপায় কী? আমি সাধারণ বোধে কোন গণতান্ত্রিক পথ খুজেঁ পাই না। আচ্ছা বুঝলাম তারা মনে করছে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া গণতন্ত্রের মুক্তি নেই। তাহলে নির্বাচনে এসে পদ্ধতি বদলান? কিন্তু একটি নির্বাচিত দল মনে করছে সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচনের সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি । সেটা মেনে নেয়াই তো গণতান্ত্রিক ।
কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হচ্ছে না। নির্বাচনের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন বিরোধী একটি পক্ষ। দলের মধ্যে যদি কেউ কোন নির্বাচন করতে চান তাকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। ভারতের নির্বাচন নিয়ে হাজার বিরোধিতা, প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্নের পরেও সবাই স্বতস্ফূর্ত ভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এতে প্রমাণ করে ভারতীয় রাজনীতিকরা জানেন দিন শেষে তারা গণতান্ত্রিক। মূল ক্ষমতা জনগণের হাতে। তাদের রায়ের ওপর বিশ্বাস না রেখে উপায় নেই। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নির্বাচন বিরোধী দলগুলোর কাছে প্রশ্ন তোলা যায়, তারা জনগণের রায়ের ওপর নির্বাচনটা ছাড়তে পারেন না কেন? নির্বাচনই যদি না করবেন তাহলে রাজনীতি করেন কেন? উদ্দেশ্য কী? দেশের বাইরে নিজের দেশকে প্রশ্নবিদ্ধ চেহারায় রেখে লাভ কী?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।