প্রফেসর ড. এম. এম. মাহবুব আলম
১ জানুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশের ঢাকাস্থ তিন নম্বর শ্রম আদালতের বিচারক শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে শ্রমিকদের করা একটি মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয় এবং শ্রম আইনের দু’টি ধারায় মোট ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় দেন বলে আদালত থেকে জানানো হয়। বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি-তর্কের সমান সুযোগ প্রদানসহ ১০ টি তারিখে শুনানির পর আদালত এ রায় প্রদান করেন।
তাছাড়া, শ্রম আদালতের আপিল কোর্টে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলেরও সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আদালত কর্তৃক প্রদত্ত এ রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
গত ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা- ওয়াশিংটন পোস্টে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার রায় এবং দুদকের মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব স্থানীয় ২৪২ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবরে লেখা একটি খোলা চিঠি বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান দুটি মামলা পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় ঐ চিঠিতে।
এর আগে, গত ৭ মার্চ ২০২৩ তারিখে 'অন্যায় আচরণের শিকার’- এমন অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশ্বের ৪০ বিশিষ্ট ব্যক্তির দেয়া খোলা চিঠিটিও বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয় ওয়াশিংটন পোস্ট নামক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একই পত্রিকায়।
বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় চলমান মামলা প্রভাবান্বিত করার নজির পশ্চিমা দেশসমূহ কিংবা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশে যে নেই তা আমি বলতেই পারি। কেননা বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলা সরকার করেনি বরং শ্রমিকরা করেছেন। সুতরাং, তাঁর বিরুদ্ধে চলমান এ মামলা বা মামলাসমূহ বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সম্পন্ন হওয়াই একান্ত কাম্য।
বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলা নিয়ে বিদেশি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ, স্বল্পোন্নত বাংলাদেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। ওয়াশিংটন পোস্ট যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা। এতে বিজ্ঞাপনের খরচও অনেক।
গত ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ওয়াশিংটন পোস্টের ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ড. ইউনুসের প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি ছিল ১৯ ইঞ্চির ৫ কলামে । সাদাকালো পাতায় প্রতি কলাম ইঞ্চি বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যয় করতে হয় ৮০৭ ডলার । সে হিসেবে এ বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ হয়েছে ৭৬ হাজার ডলারের বেশি, অর্থাৎ প্রতি ডলারের মূল্য ১০৭ টাকা দরে বাংলাদেশি টাকায় ৮০ লাখ টাকারও বেশি।
এছাড়া, গত ৭ মার্চ ২০২৩ তারিখে 'অন্যায় আচরণের শিকার’- এমন অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশ্বের ৪০ বিশিষ্ট ব্যক্তির দেয়া যে খোলা চিঠিটি ওয়াশিংটন পোস্টের ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয় তা ছিল ১৮.৫ ইঞ্চির ৫ কলামে।
সাদাকালো পাতায় প্রতি কলাম ইঞ্চি বিজ্ঞাপনের জন্য ৮০৭ ডলার হারে এ বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ হয়েছে ৭৪ হাজার ডলারের বেশি, অর্থাৎ প্রতি ডলারের মূল্য ১০৭ টাকা দরে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮০ লাখ টাকা।
বাংলাদেশের আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবান্বিত করতে এ ধরনের অর্থ ব্যয় স্বাধীন বিচার কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে বলে আমি মনে করি। কেননা, বিচার-আদালত ধনী-গরীব সকল মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল ও ভরসার জায়গা।
ধনীরা যদি প্রচুর অর্থ ব্যয় ও বিদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা বিশিষ্টজনদের দ্বারা কোন বিচারাধীন মামলাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় তাহলে এদেশের অগণিত দরিদ্র মানুষের আদালতে ন্যায় বিচার পাবার আশা পরাহত হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা বিদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা বিশিষ্টজনদের চিঠি বিদেশি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের বিষয়টি আমার কাছে খুবই অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। কেননা সাধারণত যাকে চিঠি লেখা হয়, তাকেই সেটি পাঠানো হয়। অথচ ড. ইউনূসের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠি ছাপানো হয়েছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হিসেবে।
তাছাড়া বাংলাদেশের পত্রিকায় বিজ্ঞাপনটি ছাপা হলে, সেটি প্রধানমন্ত্রীসহ সারাদেশের মানুষ জানতো। কিন্তু তা ছাপা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পত্রিকায়। যা ছাপাতে অনেক ডলার খরচ করতে হয়েছে। যার উদ্দেশে চিঠিটি লেখা তাকে তা সরাসরি না দিয়ে হাজার হাজার ডলার খরচ করা বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের বিচার-আদালতে চলমান মামলা দেশে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে সুস্থ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা বিশিষ্টজনদের দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করানোর প্রচেষ্টা থেকে বিরত থেকে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: প্রফেসর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।