![](https://www.nilphamaribarta.com.bd/wp-content/uploads/2023/05/IMG_20230510_063042-scaled.jpg)
নীলফামারীর প্রথম শ্রেণীর সৈয়দপুর পৌরসভার কসাইখানা (কিলখানা) বেহাল হয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত জায়গার সংকট, চারপাশে দূর্গন্ধযুক্ত ময়লা আবর্জনার স্তুপ, মোটর চুরির ফলে পানির স্বল্পতা, কুকুর ও কাকের উপদ্রব, খোলা জায়গায় রোদ-বৃষ্টিতে দূর্ভোগ। এসব নানা সমস্যার কারণে চরম জটিলতায় পশু জবাইয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কসাইদের। দীর্ঘ দিন থেকে এ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও সমাধানের কোন উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের।
ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জবাই ও খালগিরি করা হচ্ছে। একারণে গোশতে নোংরা লেগে থাকাসহ কুকুর ও কাকের থাবায় রোগজীবাণু মিশছে। সেইসাথে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় রোগাক্রান্ত, গর্ভবতী ও অসুস্থ পশু জবাই করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে চরম স্বাস্থ্যঝ্ুঁকিপূর্ণ হয়ে ভোক্তার হাতে পৌঁছাচ্ছে গোশত। যা অত্যন্ত ক্ষতিকর ও আশংকাজনক। এথেকে পরিত্রাণে আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (১৬মে) সকালে সৈয়দপুর শহরের নয়াবাজার সুরকী মহল্লার ভাগাড় এলাকায় কিলখানায় গেলে দেখা যায়, মূল শেডের ভিতরে ও বাইরের খোলা চত্বরে গাদাগাদি করে ২০ টি গরু জবাই করে চামড়া ছিলার কাজ করছে কসাইরা। মেঝেতে রক্ত, গবরের একটা স্তর তৈরী হয়েছে। এর মধ্যেই চলছে গোশত কাটার কর্মযজ্ঞ। পাশেই গরুর ভুঁড়ির, চামড়ার ও গোশতের উচ্ছিষ্ট ফেলা হয়েছে। সেগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক আর দলে দলে কুকুরের হুরোহুরি।
এসবসহ ভাগাড়ের ময়লা আবর্জনা মাড়িয়ে কাক-কুকুড় ছুটাছুটি করছে শেডের ভিতরে-বাইরের চত্বরে। সেখানে আস্ত চামড়া ছেলা গরু আর গোশতের বড় বড় অংশের উপরে নোংরা পায়ে বসে ঝিল্লি টেনে ছেঁড়ায় ব্যস্ত কাক। একইভাবে কুকুরেরা সুযোগ বুঝে দাঁত বসাচ্ছে গোশত কামড়ে খাওয়ার জন্য।
কখনো কখনো পুরো রান বা অন্য কোন কাটা অংশ কয়েকটা কুকুর মিলে কামড়ে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করছে। অথচ এসব যেন তোয়াক্কাই করছেনা গোশত ব্যবসায়ীরা। এমনকি সেগুলো না ধুয়েই তারা ওই অবস্থাতেই গোশত রিকশা, ভ্যান ও অটোতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাজারে দোকানে।
এদৃশ্য নাকি নিত্যদিনের। এমন মন্তব্য করে জবাই করার জন্য গরু নিয়ে চত্বরের সামনে অপেক্ষমাণ কসাইরা জানান, ছোট বড় মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৮০ টি গরু জবাই হয় এই কিলখানায়। কিন্তু জায়গা না থাকায় একসাথে ১০ টির বেশি পশু জবাই সম্ভব হয়না। এসময় অন্য কসাই বা পশু মালিকদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
তাছাড়া একটি পশু জবাই, চামড়া ছিলা ও বিভিন্ন অংশ পৃথক করা এবং ভুঁড়ি পরিষ্কার করতে গড়ে নুন্যতম আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময় লাগে। পানি স্বল্পতার কারণে গোশত ধোয়া আর রক্ত পরিষ্কার করতে আরও বেশি সময় লাগছে। ফলে সবগুলো গরুর খালগিরি শেষ করতে সময় লেগে যায় কমপক্ষে প্রায় ৫-৭ ঘন্টা। এতে ভোর ৫ টায় শুরু করলেও সকাল ১০ টা থেকে বেলা ১২ টা বেজে যায়। শুক্রবার হলেতো আরও সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ এইদিন দ্বিগুণ পশু আসে।
এক কসাই বলেন, এরপরও আমরা এখানে পশু জবাই করতে আনি। সারাবছর অনেক কষ্ট করে কাজ করি। বর্ষায় এই ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। এখন রোদে পুড়ছি আর তখন পানিতে ভিজে রক্ত, কাদা আর নোংরা ময়লায় একাকার হয়ে পড়ে শেডসহ বাইরের অংশ। কিলখানা থেকে রাস্তা পর্যন্ত ময়লায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরমধ্যেই গরু আনা জবাই করা ও গোশত নিয়ে যাওয়া কি যে অসহনীয় দূর্ভোগের ব্যাপার তা না দেখলে বলে বুঝানো মুশকিল।
এসময় অপর একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের এই ভোগান্তি বিষয়ে বার বার বলেও কোন সুরাহা পাইনি। পৌর কর্তৃপক্ষ বা কিলখানার ইজারাদার কেউই কোন পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ পশু প্রতি ১০০শত টাকা করে দিতে হয়। বিনিময়ে সামান্য সেবা পাইনা। আবার কিলখানা ছাড়া অন্য জায়গায় করলে এসব ভোগান্তিও নাই, টাকাও লাগেনা। কিন্তু আইনের নামে আমাদেরকে এই দূর্ভোগ পোহাতে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে এখন অনেকেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিজ নিজ উদ্যোগে পশু জবাই করছে।
অভিযোগ উঠেছে, ২ লাখ ৭০ হাজার টাকার কসাইখানা নিতে হয়েছে ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। সিন্ডিকেট করে একটি চক্র এভাবে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ যদি সঠিক দরে ইজারা দেয়া হতো তাহলে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে কিলখানার উন্নয়ন করতে পারতো ইজারাদার। অথবা সব টাকা যদি পৌরসভার তহবিলে জমা হতো তাহলে সেই টাকাতেও কাজ করা যেত। কিন্তু টাকা ঠিকই ব্যবহৃত হয়েছে, তবে তা চলে গেছে ব্যক্তিগত পকেটে।
এব্যাপারে সৈয়দপুর গোশত ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও কিলখানার ইজারদার মো. নাদিম কোরাইশীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, নিজের টাকাই তুলতে পারছিনা। সেখানে সেবা কি দিবো? ইজারার টাকা দিয়েইতো উন্নয়ন করতে পারে পৌরসভা। কিন্তু বর্তমান পৌর কর্তৃপক্ষ কোন কাজই করছেনা। অথচ শেডের পরিধি বাড়ানোসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান খুবই জরুরী।
তিনি আরও বলেন, কসাইদের কষ্টের কথা ভেবে সকল সদস্যের যৌথ স্বাক্ষরে একাধিকবার লিখিত আবেদন জানিয়েছি পৌর মেয়রকে। কিন্তু তিনি বার বার আশ্বাস দিলেও কিছুই করেননি। কোন রকম ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নিয়জিত কর্তৃপক্ষও নিয়মিত আসেন না। উন্নয়ন না করায় ঠিকমত তদারকি করতেও পারছেনা।
সূত্র মতে, আগামী মাসে পূর্বের টেন্ডারের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন করে টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দিতে আবারও টাকার খেলা চলবে। কিন্তু কিলখানার কোন উন্নতি হবেনা। সাবেক মেয়র আমজাদ হোসেন সরকার ও আখতার হোসেন বাদল যেটুকু করে গেছেন সেটাকে পূঁজি করেই সবাই নিজ নিজ পকেট ভারি করছেন।
এজন্য কসাইদের পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে দ্রুত বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা হোক। নয়তো যেই ইজারা নিক এত কষ্ট করে আর কিলখানায় পশু জবাই করবেনা তারা। এতে প্রয়োজনে ব্যবসা বন্ধ করে দিবে নয়তো আন্দোলনে নামবে তারা। তাদের প্রতি সহমত পোষণ করে সচেতন সৈয়দপুরবাসীও উন্নয়ন করাসহ যথাযথ নিয়ম প্রতিপালনে তদারকি ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং মানসম্মত গোশত সরবরাহে পৌর কর্তৃপক্ষসহ প্রশাসনের সার্বিক হস্তক্ষেপ আশা করেছেন।
এনিয়ে কথা বলতে পৌর সচিবের কাছে গেলে তিনি সাংবাদিক দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং বলেন, আমি কোন মন্তব্যই করতে পারবোনা। মেয়রের অনুমতি নিয়ে আসেন তারপরও কথা বলবো। কারণ কথা বললে আপনারা যাওয়ার পর যে চাপ আসবে তা কি আপনারা সমাধান করবেন? কার, কি ধরণের চাপ জানতে চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
সৈয়দপুর উপজেলা সেনেটারী ইন্সেপেক্টর আলতাব হোসেন বলেন, কসাই খানা ময়লা, আর্বজনার ভাগারে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেখানে কোন পরিবেশ নাই। অস্থ্যকর পরিবেশে গরু জবাই হচ্ছে। তদারকি করতে গেলে সেখানে দূরগন্ধে থাকা যায় না। বার বার মেয়র ও পৌর পরিষদকে অভিযোগ করে কোন সমাধান হয় নি।
সৈয়দপুর উপজেলা প্রানীর সম্পদ কর্মকর্তা ডা: শ্রী শ্যামল কুমার রায় বলেন, কিলখানার পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাদের কোন লোক বল সেখানে নিয়জিত নাই। কারন পৌরসভা থেকে এ ব্যাপারে কখনই আবেদন করা হয় নি।
সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: আলিমুল বাশার বলেন, গরু জবাইয়ের পূর্বে অবশ্যই গরু স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরী অসুস্থ গরু হলে সে ক্ষেত্রে জবাই করা যাবে না। অসুস্থ বা রোগান্ত গরুর গোস্ত খেলে পেটে পীড়া, ডাইরিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়া সম্ভবনা বেশি থাকে।
পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, পৌরসভার নিজস্ব কোন চিকিৎসক বা মেডিকেল এসিস্টেন্ট নাই। তবে কনজারভেন্সি বিভাগের মমিনুল ইসলাম ও তথ্য কর্মকতার্ আকমল সরকার রাজু এ বিষয়ে তদারকির দায়িত্বে আছেন। তারাই সঠিক বলতে পারবেন। কিন্তু তারাও পৌর সচিবের মতো মন্তব্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
সৈয়দপুর পৌরসভা মেয়র ও পৌর মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রাফিকা আকতার বেবীর মোবাইল ফোনে নাম্বারে ০১৭৯৭৮৬০২৬১ কয়েক বার যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয় নি।