বিচার ঠেকাতে ড. ইউনূসের বিবৃতি ভিক্ষা কেন?

-বিপ্লব কুমার পাল

ঘটনা-১: পাবনার ঈশ্বরদীতে ৩৭ জন প্রান্তিক কৃষকের একটি গ্রুপ বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের পাবনা জেলা কার্যালয় থেকে ঋণ নেয়। ২০২১ সালে ঋণ খেলাপির দায়ে ব্যাংকের পক্ষে তৎকালীন ব্যাংক ম্যানেজার তাদের নামে মামলা করেন। আদালতের আদেশে পুলিশ ওই কৃষকদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। পরবর্তীতে কৃষকদের জামিন দেয় আদালত।
ঘটনা-২: কর ফাঁকির মামলায় ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহিদ উদ্দিন চৌধুরীকে নয় বছর কারাদন্ড দেয় ঢাকার বিশেষ জাজ আদালত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়ের করা এ মামলার রায়ে বলা হয়, আসামির বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, অপ্রদর্শিত আয় এবং মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
ঘটনা -৩: শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে ইসটকে পড়েন সভারের বিরুলিয়া এলাকার অমর ফ্যাশন লিমিটেডের মালিক। ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর ভুক্তভোগী ৬৯ শ্রমিকের পক্ষে সাভার মডেল থানায় মামলা করা হয়। এরপর ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকার ইর্স্টান হাউজিংয়ের রোডের একটি বাসা থেকে ওই কারখানার পরিচালক মরিয়ম হোসেন কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
উপরের তিনটি আলাদা ঘটনা। ভিন্নভিন্ন অপরাধ। ঋণ খেলাপির দায়ে যেমন কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার হয়েছে। আবার তারা জামিনও পেয়েছেন। কর ফাঁকির মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাজা পেয়েছেন অবসর প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। আবার শ্রমিক দের মজুরি না দেওয়ার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন তৈরি পোশাক কারখানার মালিক। তিনটি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। এমন অসংখ্য মামলার বিচার চলছে আদালতে। সেই বিচার ঠেকাতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিবৃতি দেয়নি। আইন তার গতিতে চলেছে।অপরাধী হলে সাজা হয়েছে, নিরাপরাধী হলে মুক্তি পেয়েছেন।শুধু ব্যতিক্রম বাংলাদেশি নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বেলায়। শতাধিক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সহ বিশ্বের দেড় শতাধিক ব্যক্তি প্রধান মন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লিখে এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছেন। পাশাপাশি চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানান। এ দিকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের আরও শতাধিক নাগরিক। ইউনূসের বিরুদ্ধে হওয়া সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জাফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দেশের আদালতে গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজারের বেশি মামলা হয়। বিপরীতে নিষ্পত্তি হয় সাড়ে ৩ হাজার। মামলার বিচারে নিরাপরাধ হলে খালাস পান। আবার দোষী সাব্যস্থ হলে দন্ড হয়।কিন্তু সবাই আইনের মুখোমুখি হয়। কিন্তু ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিচার ঠেকাতে সরকারের ওপর নানামুখি চাপ তৈরি করা হচ্ছে। কখনও বিদেশ থেকে ফোনে হুমকি আসছে, কখনও অনুরোধ, আবার কখনও খোলাচিঠি। সেই সাথে দেশের কিছু ব্যক্তি ড. ইউনূসের জন্য বিবৃতির দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।
১০৫ জন নোবেল বিজয়ী সহ ১৭৬ জান বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যে চিঠি দিয়েছেন, তা প্রকাশিত হয়েছে ওয়ার্ড প্রেসের একটি সাব ডোমেইনে। ‘ইউনূস কে রক্ষা করুন’ নামের এই সাবডোমেইনটি ঘেঁটে ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক মহলের যোগাযোগ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ওয়ার্ড প্রেসের ব্লগে থাকা একই নামের একটি টুইটার একাউন্টে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ফলোয়ারের সংখ্যা মাত্র ৬৩ জন। এমনকি ব্লগ পোস্টটি যে টুইটারে পোস্ট আকারে দেওয়া হয়েছে, সেখানেও প্রতিক্রিয়া মাত্র ৫টি, রি-টুইট মাত্র ২টি। প্রশ্নহলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এই চিঠিটি ওয়ার্ডপ্রেসের একটি সাবডোমেইনেই প্রচার করতে হলো কেন? তাছাড়া টুইটার রিঅ্যাকশন থেকে বোঝা যায়, চিঠিটির বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের।গুরুত্বপূণর্ ব্যক্তিদের নাম থাকলেও চিঠির ভাষা পড়েই বোঝা যায়, সংবিধান জানা কোনো ব্যক্তি এই চিঠি লেখেননি বা চিঠির বক্তব্য তারা পড়ে দেখেননি।যদিও বাংলাদেশের বিচারিক আওতাধীন না হওয়ায়, বাংলাদেশের আইন মানার কোনো বাধ্য বাধকতা তাদের নেই।
চিঠি পড়ে বোঝা যায়, ১৭৬ জন বিশ্বনেতাদের মূল বক্তব্য হলো- ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম যেন বন্ধ করা হয়। কিন্তু চিঠিটি পাঠানো হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যিনি রাষ্ট্রেরনির্বাহী বিভাগের প্রধান।বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা। কিন্তু চিঠির চতুর্থ অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় বাক্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘বিচারিক প্রক্রিয়া বন্ধের আবেদন’ করা হয়েছে।
চিঠির তৃতীয় অনুচ্ছেদে জানানো হয়, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলাকে স্বাক্ষর দাতাগণ মানবাধিকারের বিরুদ্ধে হুমকি মনে করছেন। অথচ মামলার নথিতে থাকা প্রতারণার শিকার শ্রমিকদের দুর্দশা তাঁদের চোখ এড়িয়েগেছে। ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ টেলিকমের ফাঁদে পড়ে হাজার হাজার মানুষ সর্বশান্ত হয়েছেন।তাদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। শ্রমিক বলে তাদেরকি বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার নেই?
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে তারা চিন্তিত এবং “তারা মনে করেন” যে, ড. ইউনূস বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অথচ পৃথিবীর যে কোনো দেশেই আইন সকলের জন্য সমান।কোনো অভিযোগ থাকলে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তার সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো অবস্থানই বিচার করেনা আদালত।এটাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথমশর্ত। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যে আইনি কার্যক্রম চলমান, তা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই চলছে। শ্রম আইন লঙ্ঘন, করফাঁকি সহ বেশ কয়েকটি সংবেদনশীল মামলার আসামি ড. ইউনূস। চিঠির চতুথর্ অনুচ্ছেদে মন্তব্য করা হয়েছে, বর্তমান বিচারক প্যানেলকে তারা নিরপেক্ষ মনে করছেন না। যা রীতিমত বাংলাদেশের আইনে আদালত অবমাননার শামিল।
ড. ইউনূসের পক্ষে ১৭৬ জন স্বাক্ষরদাতার মধ্যে ১০৫ জন নোবেল বিজয়ী। কিš ‘ আশ্চর্যের ঘটনা-১০৫ জনের মধ্যে ৬৪ জনই ডেমোক্রেটদের শাসনামলে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অর্থাৎ স্বাক্ষরকারী নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে ৬১ শতাংশ ডেমোক্রেট আমলে নোবেল বিজয়ী। ডেমোক্রেটদের সঙ্গে ড. ইউনূসের সম্পর্ক নানা কারণেই বেশ ঘনিষ্ঠ।হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারণাতে ও ইউনূস মোটা অংকের ফান্ড দিয়েছিলেন।
ড. ইউনূসের জন্য বিদেশ থেকে খোলা চিঠি এলেই কী তিনি নিরাপরাধ হয়ে যাবেন? অপরাধীনা হলে আইনের মুখোমুখি হতে অসুবিধা কোথায়? তাকে তো আর কৃষকের মতো কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়নি।তাছাড়া দেশ-বিদেশে তার অনেক বিশিষ্ট আইনজীবীবন্ধু আছেন। তারাই আইন দিয়ে আইনের মুখোমুখি হতে পারেন, প্রমাণ করতে পারেন ড. ইউনূস নিরাপরাধ। প্রধানমন্ত্রী ও সে কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, আপরাধ না করলে, আত্মবিশ্বাস থাকলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দাতাদের বিশেষজ্ঞ পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একজনের জন্য এত এত বিবৃতি না দিয়ে এক্সপার্ট পাঠাক।এত দরদ থাকলে আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞ পাঠাক। যার বিরুদ্ধে মামলা, তার সব দলিল-দস্তাবেজ তারা খতিয়ে দেখুক। সেখানে কোনো অন্যায় আছে কি, তারা নিজেরাই দেখুক।তাদের এসে দেখা দরকার, কী কী অসামঞ্জস্য আছে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই চ্যালেঞ্জকে ড. ইউনূসের গ্রহণ করা উচিত। শুধু খোলাচিঠি না লিখে, বিদেশি বন্ধুদের বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করুন। তারা দেশে এসে মামলার কাগজপত্র দেখে আদালতে প্রমাণ করুন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ মিথ্যা। তাহলে দেশের মানুষ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আর একটি প্রশ্নও তুলতে পারবে না।আর সরকার ও তার দিকে কোনো অভিযোগ তোলার সাহস পাবেনা।
লেখক: গণ মাধ্যম কর্মী।

  • Related Posts

    পার্বতীপুরের বেলাইচন্ডীতে শহীদ জিয়া স্মৃতি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট চতুর্থ খেলা অনুষ্ঠিত

    দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বেলাইচন্ডী ইয়ং সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত শহীদ জিয়া স্মৃতি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের চতুর্থ খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) সাড়ে তিনটায় উপজেলার বেলাইচন্ডী ইউনিয়নের বেলাইচন্ডী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মুনপুরা…

    Continue reading
    শানের কণ্ঠে ‘শ্যাম কালিয়া’

    বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে প্রতিভাবান গায়ক শান সায়েক। স্বতন্ত্র এবং প্রাণবন্ত কণ্ঠের এই গায়ক একই সঙ্গে সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও সুপরিচিত। সম্প্রতি নতুন বছর উপলক্ষে আধুনিক লোকসঙ্গীত গানের ভিডিও নিয়ে শ্রোতাদের…

    Continue reading

    সকল

    নীলফামারী জেলা স্কাউটস এর সম্পাদক হলেন আতাউর রহমান

    নীলফামারী জেলা স্কাউটস এর সম্পাদক হলেন আতাউর রহমান

    চিরিরবন্দরে এবি পার্টির মতবিনিময় সভা ও শীতবস্ত্র বিতরণ

    চিরিরবন্দরে এবি পার্টির মতবিনিময় সভা ও শীতবস্ত্র বিতরণ

    ১৪ ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের আগে একবার ভাবুন : আহমাদুল্লাহ

    ১৪ ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের আগে একবার ভাবুন : আহমাদুল্লাহ

    অনিরাপদ বোধ করছি : পরীমণি

    অনিরাপদ বোধ করছি : পরীমণি

    ঈদ করেই দেশে ফিরবেন খালেদা জিয়া

    ঈদ করেই দেশে ফিরবেন খালেদা জিয়া

    জলঢাকায় অনগ্রসরদের অধিকতর অন্তর্ভুক্তি শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

    জলঢাকায় অনগ্রসরদের অধিকতর অন্তর্ভুক্তি শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

    সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাই স্কুলের ৪০তম বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

    সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাই স্কুলের ৪০তম বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

    সৈয়দপুরে মহিলালীগ নেত্রী ববি গ্রেপ্তার

    সৈয়দপুরে মহিলালীগ নেত্রী ববি গ্রেপ্তার

    তিস্তা বাঁচাও নদী বাচাঁও প্রচারনা ও পথসভা

    তিস্তা বাঁচাও নদী বাচাঁও প্রচারনা ও পথসভা

    আজ নির্বাচন কমিশনে যাবে জামায়াতে ইসলামী

    আজ নির্বাচন কমিশনে যাবে জামায়াতে ইসলামী