অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম
‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ আইন প্রণয়নের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্য প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশের বিশাল সামুদ্রিক এলাকা থেকে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। একজন সরকার প্রধানের সময়োপযোগী এই গুরুত্বারোপ দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধে কার্যকারী ভূমিকার পাথেয়।
‘বাংলাদেশ’ ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে দক্ষিণ এশিয়ার তথা বিশ্ব দরবারে রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে বিতর্কিত সামুদ্রিক এলাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক রায়ের (২০১২ সালে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং ২০১৪ সালে ভারত বিরুদ্ধে) পর, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা দাঁড়ায় প্রায় ১১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার (মূল ভূখণ্ডের ৮১ শতাংশ পরিমাণ)। সঙ্গে আছে ৩৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার প্রসারিত মহীসোপান, যার গড় গভীরতা ৫০ মিটার পর্যন্ত। ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণীজ ও অন্যান্য সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার রয়েছে আমাদের। বাংলাদেশের এই সমুদ্র এলাকা মূলত দুটি প্রধান সিস্টেম বা অঞ্চল নিয়ে গঠিত, যথা: উপকূলীয় ও সামুদ্রিক সেক্টর। উপকূল থেকে ৫০ মিটার গভীরতা এবং উপকূলরেখা থেকে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয় উপকূলীয় অঞ্চল। অন্যদিকে ৫০ মিটারের বেশি গভীর থেকে গভীর সমুদ্র অঞ্চলকে ধরা হয় সামুদ্রিক সেক্টর। বাংলাদেশের উপকূলরেখা বিস্তৃত দক্ষিণ-পূর্বে জীবন্ত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন পর্যন্ত মোট ৭১০ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পরিবেশ পৃথিবীর অন্যতম একটি আশির্বাদপুষ্ট অঞ্চল। এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু বৈশিষ্ট্যযুক্ত উচ্চ বৃষ্টিপাত এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ নদী প্রবাহ দ্বারা সৃষ্ট। এই অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর মৎস্য উৎপাদনের সম্ভাবনা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলাশয় বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ উৎপাদনশীল বাস্তুতন্ত্রের একটি। বাংলাদেশ সমুদ্রসীমায় রয়েছে জীবিত ও নির্জীব উভয় সম্পদের একটি সমৃদ্ধ রিজার্ভ। জীবিত সম্পদের (প্রাণী এবং উদ্ভিদ) মধ্যে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, মলাস্ক, কচ্ছপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, উভচর পাখি, প্ল্যাঙ্কটন ইত্যাদি। গবেষণায় জানা যায়, এই সমুদ্রসীমায় রয়েছে ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মাছ (IUCN ২০১৫), ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৬২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস, ২২০ প্রজাতির সি-উইড ও ১৫৬ প্রজাতির শৈবাল। নির্জীব সম্পদের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো হাইড্রোকার্বন মজুতে সমৃদ্ধ বলে মনে করা হয় । একটি ব-দ্বীপ হওয়ায় এবং একটি ছিদ্রযুক্ত এবং ভেদযোগ্য হাইড্রোকার্বন বহনযোগ্য বালির কাঠামো এবং ফাঁদের অনন্য অবস্থার কারণে বাংলাদেশ সবসময়ই একটি প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচিত।
আমরা যদি শুধু মৎস্য সম্পদের কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায়, এই বিশাল প্রজাতির মধ্যে অনেক প্রজাতি এখনও আমাদের আহরণের মধ্যে আসেনি। এমনকি, গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের সক্ষম উন্নত ভেসেল আমাদের নেই। আমরা জানি না আসলে আমাদের কত প্রজাতির মৎস্য সম্পদ আছে, তাদের মজুত কেমন। আমাদের প্রতিবেশি দুই দেশ এদিক থেকে অনেক আগিয়ে রয়েছে এবং সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহার করে তারা তাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পৃথিবীর অনেক দেশ শুধু উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য চাষ করে তাদের মৎস্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। সে হিসেবে আমাদের উপকূলীয় চিংড়ি চাষ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো মাছ চাষ নেই, সামুদ্রিক মাছ চাষের কথা বাদই দিলাম।
জনসংখ্যায় বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। যদিও আয়তনে বিশ্বে ৯২তম। ছয়টি ক্ষুদ্র দ্বীপ ও নগররাষ্ট্রের পরেই বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও কম এই ক্ষুদ্রায়তনের দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি, অর্থাৎ প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৮৮৯ জন (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১৪০ জন)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার। বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দুই কোটি এক লাখ ৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি হিসেবে, মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৪ হেক্টরে। ২০৪১ সালে যখন জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২১ কোটিতে তখন মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ অনেক কমে যাবে। এই বিশাল জনসংখ্যার জীবন-জীবিকা নির্বাহের উৎস খুঁজতে হবে আমাদের। যদিও আমরা টেকনোলজি অথবা আইটি সেক্টরে আরও এগিয়ে যাব, তারপরও কৃষি নির্ভরতা আমাদের মূল চাবিকাঠি থাকবে বলে মনে করি। তাই ২০৪১ সালের উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্যান্য খাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুরুত্ব দিতে হবে সমুদ্র সম্পদ আরোহণ, টেকসই ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্যচাষসহ অন্যান্য কৃষি শিল্পের দিকে। একইসঙ্গে সমুদ্রের অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ যথা তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ আরোহণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আসতে পারে আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধি।
সম্প্রতি আরভি মীন সন্ধানী (২০১৭-১৯) আমাদের সমুদ্রের উল্লেখযোগ্য কিছু মাছের মজুত ও আরোহণের উপর গবেষণা করেছে। যদিও সঠিক ও নির্ভুল বৈজ্ঞানিক তথ্য পেতে দীর্ঘ দিনের জরিপ দরকার। সেখানে দেখা গেছে, অনেক প্রজাতির মাছ নির্দিষ্ট মাত্রা থেকে অধিক ধরা হচ্ছে আবার অনেক প্রজাতি রয়েছে অধরা। আমাদের এই বিস্তৃত উপকূলীয় ও সমুদ্র জলে আমরা নতুন-নতুন প্রজাতি ও পদ্ধতি ব্যাবহার করে মৎস্য উৎপাদনকে বাড়াতে পারি অনেকগুণ, যেটা আমাদের একদিকে যেমন প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম করবে, অন্যদিকে রফতানি করে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
আমাদের অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের মজুত ও উত্তোলনের পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। আজ পর্যন্ত আমরা জানি না গভীর সমুদ্রে তেল থাকার সত্যিকারের সম্ভাবনা এবং গ্যাস রিজার্ভ কী পরিমাণ আছে, কারণ এখনও মূল্যায়ন করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যেমন, সাসটেনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ যেটা বঙ্গোপসাগরের বিপুল মৎস্য সম্পদ আহরণে টেকসই মৎস্য মজুত, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা এবং উপকূলীয় প্রান্তিক জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অধিদফতর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়ন করছে। এরই আওতায় আমাদের উপকূলীয় জলাশয়ে নতুন-নতুন প্রজাতির বাণিজ্যিক চাষের সক্ষমতা যাচাই হচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের গবেষণার উপর আরও জোর দিতে হবে এবং যেগুলো হচ্ছে তার প্রাপ্ত ফলাফল বা সুপারিশ রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণালব্ধ ফলাফল যেন শুধু কাগুজে না হয়। একইসঙ্গে খনিজ সম্পদের মজুত ও উত্তোলনের জন্য অভিজ্ঞ জনবল নিয়ে আসতে হবে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ব্লু ইকোনমি সেল। এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বুকে ও তলদেশে যাবতীয় মৎস্য, জলজ সম্পদ ও তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং এসবের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে সমুদ্রসম্পদ মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে এ বিষয়ে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। দেশের সমুদ্রসম্পদ নিয়ে যেসব ইনস্টিটিউট/গবেষণা প্রতিষ্ঠান/বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে তাদের একটি প্লাটফরমে আনতে হবে।
তাই প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ আইন প্রণয়নের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই বিষয়ের গুরুত্বারোপ একজন রাষ্ট্রনায়কের দূরদর্শিতার পরিচায়ক। আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সমুদ্রসম্পদ ব্যাবহারের সক্ষমতার উপর অনেকটা নির্ভর করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আশাকরি বর্তমানে নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে আরও কার্যকর পদক্ষেপ ও বিদেশি বিনিয়োগের সমন্বয় ঘটাতে পারলে এই বিশাল সমুদ্রসম্পদ আমাদের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হবে।
লেখক: ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়