পলাশ আহসান

বাংলাদেশ নিয়ে আবারও উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ। এবারের ইস্যু ড. ইউনূস। জাতিসংঘের অফিসে মহাসচিব আন্থোনিও গুতেরেসের হয়ে তার মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক তাদের নিয়মিত প্রেসব্রিফিংএ জনিয়েছেন এই উদ্বেগ। তিনি বলেন, ইউনূস জাতিসংঘের অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা চরম উদ্বেগের। এর একদিন আগে ঢাকায় ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমসহ আটটি প্রতিষ্ঠান দখল হওয়ার দাবি করে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, আমাদের আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল হয়ে গেছে। গ্রামীণ ব্যাংক এখন নিজেদের মতো করে এসব প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে তালা মেরে রেখেছে। নিজের বাড়িতে অন্য কেউ যদি তালা মারে, তখন কেমন লাগবে? দেশে আইন–আদালত আছে কিসের জন্য?

ঢাকার এই সংবাদে সম্মেলনে সূত্র ধরে জাতিসংঘের নিয়মিত প্রস ব্রিফিংএ প্রশ্ন করেন, সরকারের বিপক্ষে বিদেশিদের উস্কানোর সেই পরিচিত মুখ মুশফিক ফজল আনসারি। তিনি বলেন, সরকার সব গ্রামীণ কার্যালয় দখল করে নিয়েছে। ইউনূসের বিরুদ্ধে নতুন করে আরেকটি মামলা দায়ের করেছে ক্ষমতাসীন সরকার। তার এই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব কী অবগত রয়েছেন? জবাবে গুতেরেসের মুখপাত্র ডুজারিক বলেন, তারা সব জানেন। জাতিসংঘের কাছে খুব মর্যাদাবান ব্যক্তি ইউনূস। তিনি জাতিসংঘের অনেক কাজ করে দেন। তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে তারা চরমভাবে উদ্বিগ্ন।

এখন আমরা দেখে নিতে পারি, ঠিক কোন বিষয়ের ওপর কেন জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন। এর জন্যে আমাদের ভিভিন্ন সময়ের গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য উপাত্ত দেখতে হবে। যে অভিযোগ ইউনূস সাহেব করছেন এর গোড়ায় কী ছিল? ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক গঠন করা হয়েছিল। এসময় গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের পরিশোধিত মূলধন শূন্য ছিল । অর্থাৎ এর মূলধন ছিল পুরোটাই সরকারের। সেসময় আইনে গ্রামীণ ব্যাংককে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান করার কোনো এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। তাই আজ যে প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো তৈরির সময়ই আইন ভাঙা হয়েছিল। 

প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ শক্তি, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন; গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন এবং গ্রামীণ উদ্যোগ। গ্রামীণ ব্যাংক অনুসন্ধান কমিটির ২০১২ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মোট ৪০ টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থায়নে মোট ৫৪ টি প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে বলছে দেশের গণমাধ্যমগুলো। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকই পরিচালনা করছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালকরাই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালক ছিলেন। তবে সম্প্রতি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি না থাকায় এবং ব্যাংকে ইউনূসপন্থী পরিচালকদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন ম্যানেজমেন্ট তার আওতাভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজমেন্টেও পরিবর্তন এনেছে।

১৯৮৩ সালের আইন মেনে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানে যে পরিবর্তন এনেছে এটিকেই দখল বলছেন ইউনূস সাহেব। তার দাবি এই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ বিদেশি কোম্পানি টেলিনরের সঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের শেয়ার বিতর্কের সময় তিনি নিজেই বলেছিলেন, গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণমাধ্যমে বহুবার এসব বক্তব্য ছাপা হয়েছে। সম্প্রতি গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের বেতন ভাতা নিয়ে চলমান মামলায় আদালতে উত্থাপিত নথি থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে।

সংগঠনগুলোর ওয়েবসাইটেও একই তথ্য দেখা যায়। ২০০৬ সালে অ্যাশডেন পুরস্কার বিজয়ের সময় গ্রামীণ শক্তি অ্যাশডেনকে নিজেদের যে পরিচিতি দেয়, তাতে বলা হয়েছে, এ্ই প্রতিষ্ঠানটি সহজে গ্রামের মানুষের কাছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পৌঁছে দেয়ার জন্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। আর এখনকার সুর ভিন্ন। ইউনূসের আরও নানা কৌশল এরই মধ্যে গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছে। একেক কৌশল একেক কারণে করেছেন তিনি। এর কোনটি ব্যবহার করেছেন কর ফাঁকি দিতে। কোনটা করেছেন কর্মচারিদের ন্যায্য পাওনা না দেয়ার জন্যে, আবার কোন টা বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক বাাড়াতে। এমনকী তাঁর মিথ্যাচার আদালতের বাইরে মিটমাট করার তথ্য প্রামাণিত হয়েছে। এরইমধ্যে পুরো বিষয়গুলোই প্রকাশ্য ।

এত সব জানা তথ্য সাবার সামনে। অথচ জাতিসংঘেষের সংবাদ সম্মেলনে ডুজারিককে কেউ জিজ্ঞাসা করলো না, ইউনূস সম্পর্কে আনসারি যেটা বললো, এর বাইরে কোন সত্য আছে কী না? জাতিসংঘের জন্যে কেউ কোন কাজ করলে, তার জন্যে যেকোন অপরধ করা বৈধ কী না? কোন ঘটনার আদ্যপান্ত না জেনে একটি স্বাধীন দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করা কূটনৈতিক সভ্যতার মধ্যে পড়ে কী না? এমন কী জাতীসংঘ কী এনিয়ে কোন তদন্ত করেছে কী না? ইউনূসের ঢাকার সংবাদ সম্মেলন আর জাতিসংঘের সংবাদ সম্মেলন এক সূত্রে গাঁথা কী না?

এরইমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক এবং সরকার আলাদাভাবে এই দুই সংবাদ সম্মেলনের জবাব দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, ইউনূসের নামে যে মামলা হয়েছে, এতে তাদের কোন হাত নেই। বিষয়ের পুরোটা এনবিআর, দুদক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীদের এখতিয়ার। গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও সাংবাদিকদের তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতিসংঘ কথা বলেছে বিচারধীন একটি বিষয় নিয়ে। যেখানে পরিস্কার পক্ষ-বিপক্ষ আছে। আমার প্রশ্ন, জাতিসংঘের মত একটি আন্তর্জাতিক সার্বজনিন সংগঠনের এরকম পক্ষপাতদুষ্ট উদ্বেগ কতটা নৈতিক?  

ইউনূস সাহেবের বর্তমান তৎপরতা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। তিনি দীর্ঘদিন নিজেই একটি পক্ষ। তার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনেও তার সঙ্গে ছিলেন সরকারবিরোধী সুশীল আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। যিনি সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে জেলে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে যাকে কুড়িগ্রামের রৌমারি সীমান্ত থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিনা অনুমতিতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করার। আরও যারা ছিলেন সবাই আগে থেকে সরকার বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত। তারা সরকারের বিরোধিতা করবেন এটাই স্বাভাবিক। এমনকী আনসারি সাহেবের উস্কানীও আমার অস্বাভাবিক মনে হয় না। আমার অস্বাভাবিক লাগে জাতিসংঘের এরকম একপাক্ষিক আচরণ। অসহায় লাগে যখন দেখি লবিস্ট ফার্মগুলো জাতিসংঘের মহাসচিবকেও টলিয়ে দিচ্ছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।