প্রভাষ আমিন

ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের ছেলে অমিত কুমারের একটা গান আছে, ‘আমি একা বড় একা/আমার আপন কেউ নেই/আশা নেই আলো নেই/শুধু যে আঘাত সবেতেই…’। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির দশা হয়েছে অনেকটা এই গানের মত। তারা চাইলে এই গান গাইতে পারে। বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নির্বিঘ্নে হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি অনেকটাই দিশেহারা। তারা আশা নিয়ে বসেছিল নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে। কিন্তু ‘নির্বাচন ভালো হয়নি’ বললেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বরং নির্বাচনের আগে বিএনপির কাছে’ভগবান’ হয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এখন যেন সরকারের ধামাধরা।

বিএনপির সাথে ‘পল্টি’ মেরেছেন তিনি। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখে সরকারের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করায় আশাহত হয়েছে বিএনপি।

নির্বাচন হয়ে গেছে। সরকার গঠন হয়ে গেছে। বিশ্ব নেতৃত্বের সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনা এখন আরো আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু বিএনপি এখন কী করবে? কাগজে-কলমে বিএনপি এখনও সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে রয়েছে। নির্বাচনের আগে ঘোষিত ‘সর্বাত্মক অহসযোগ’এর কর্মসূচিও প্রত্যাহার করা হয়নি। কিন্তু সমস্যা হলো, বিএনপির সর্বাত্মক অহসযোগে কেউ সাড়া দেয়নি। সরকার পতনের একদফা আদায়েও কোনো কর্মসূচি নেই। সব মিলিয়ে বিএনপি এখন লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন রাজনৈতিক দল। অতীতেও বিএনপির এমন অনেক কর্মসূচি ঘোষণা ছাড়াই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখনও তাদের একদফা এবং সর্বাত্মক অহসযোগ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে

বসেছে।

শুধু কর্মসূচি নয়, জোট এবং সমমনা দল নিয়েও বিএনপির কোনো স্থিরতা নেই। আজ এখানে তো কাল ওখানে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সমমনা দল মিলে আন্দোলন করা আমাদের ঐতিহ্য। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট কাঁপিয়ে দিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের মসনদ।

বাংলাদেশে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল মিলে আন্দোলন শুরু করে। পরে ১৫ দল ভেঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল এবং বামদের ৫ দলীয় জোট হয়। এই তিন জোটের মিলিত আন্দোলনেই পতন ঘটে এরশাদের। বিএনপির সাথে আদর্শিক নৈকট্য থাকলেও তখন জামায়াতে ইসলামী কোনো জোটে না থাকলেও রাজপথে অভিন্ন কর্মসূচিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়। তবে ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনেই সরকার গঠন করে বিএনপি। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতীয় পার্টি, জামায়াত এবং ইসলামী ঐক্যজোটকে সাথে নিয়ে ৪ দলীয় জোট গঠন করে আন্দোলনে নামে বিএনপি।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত মিলে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং পরে একসাথে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ বুঝে যায়, বিএনপি ও জামায়াতের সম্মিলিত ভোটের সাথে তারা একা পেরে উঠবে না। তাই আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে কাছে টেনে নেয়। তবে জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের ঐক্য ছিল কৌশলগত। আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট হলো ১৪ দল। তবে জাতীয় পার্টির সাথে জোট গড়তে অন্যদের আপত্তির কারণে আওয়ামী লীগ তাদের সাথে মহাজোট গড়ে। ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের মহাজোটের ঐক্য এখনও অটুট। তবে এই সময়ে জোট নিয়ে বিএনপির অস্থিরতা দেখা গেছে। প্রথমে তারা জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট গড়ে

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় জামায়াতের সাথে বিএনপির জোট নিয়ে নানা মহলের সমালোচনা সত্ত্বেও বিএনপি তাদের ছাড়েনি।

তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধীনে। তবে তখনও বিএনপি মূল আদর্শিক জোট ২০ দল ছিল। একদিকে জামায়াতের সাথে ২০ দল, অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট- অদ্ভূত এক সমীকরণে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। যাতে তাদের ভরাডুবি ঘটে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতেই অঘোষিত ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কেন বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে গেল, কেন মূল দাবি থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলো, যাবে না বলেও কেন সংসদে যোগ দিল, কেন আবার সংসদ থেকে পদত্যাগ করলো, কেন ঐক্যফ্রন্টের সাথে থাকলো না- তার কোনোটারই কোনো ব্যাখ্যা বা জবাব নেই। বারবার নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসার এমন নজির কোনো রাজনৈতিক দলেরই নেই।

বিএনপির মূল দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই দাবিতে তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঠিকই

দলীয় সরকারের অধীনে অংশ নেয়। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি আবার তাদের আগের অবস্থানে ফিরে যায়- দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। তবে এবার তাদের দাবি আরো কঠোর- সরকার পতনের একদফা। কঠোর দাবি আদায়ে যখন কঠোর কর্মসূচি দরকার, দরকার বৃহত্তর ঐক্যের; তখনই বিলুপ্ত হয়ে গেল ২০ দলীয় জোট। জোটবদ্ধ আন্দোলনের বদলে যুগপত আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। অন্তত ৩৯টি রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনে মাঠে নামে। নিজেদের ২০ দল বিলুপ্ত হলেও যুগপৎ আন্দোলনে সামিল হয় নানান নাম ও ধরনের জোট। ৬ দলের সমন্বয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, গণফোরাম-পিপলস পার্টির দ্বিদলীয় জোট, ১১ দলের সমমনা জোট, ৪ দলের গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ছাড়াও এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টিও অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সামিল হয় বিএনপির একদফা আন্দোলনে। বিএনপির এই যুগপৎ আন্দোলনে বাম-ডানের এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন মিশেল বিরলই বটে। ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিল নিয়ে প্রথম যুগপৎ কর্মসূচির যাত্রা শুরু। যুগপৎ কর্মসূচিতে ৩৯টি দল থাকলেও বিএনপি ছাড়া আর কারোই তেমন জনসমর্থন নেই। বিএনপির এই ৩৯ দলের যুগপৎ কর্মসূচি দেখে আমার রবীন্দ্রনাথের একটি ছড়ার কথা মনে পড়ে যায়- ‘’ভোলানাথ লিখেছিল, তিন-চারে নব্বই–/ গণিতের মার্কায়/ কাটা গেল সর্বই।/ তিন চারে বারো হয়, /মাস্টার তারে কয়; /‘লিখেছিনু ঢের বেশি’/ এই তার গর্বই।‘’

বিএনপির দশাও হয়েছিল তাই। ঢের বেশি দল নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা গেছে এটাই যেন তাদের গর্ব। কিন্তু এই গর্ব ছাড়া আর কোনো লাভ হয়নি বিএনপি। ৩৯ দল মাঠে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর সরকার বিএনপির ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে দিলে বাকি ৩৮ দলকে আর খুজেঁই পাওয়া যায়নি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন এবং বিভিন্ন দেশের অভিনন্দনের জোয়ারে বিএনপিরই এখন ভেসে যাওয়ার জোগার। তাদেরই এখন খুজেঁ পাওয়া মুশকিল।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ।