অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন

দুর্নীতি প্রতিটি সমাজ ও দেশের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। বিভিন্ন সমাজ দেশে দুর্নীতির কারণ, ধরন, ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। দুর্নীতি অনেক রূপে ঘটতে পারে। অনেকেই দুর্নীতি বলতে শুধু অবৈধ বা অনৈতিক আর্থিক লেনদেনকে বোঝে কিন্তু যা কিছু নীতির পরিপন্থী বা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা-ই দুর্নীতি।

নিজে সুবিধা না নিয়েও নিকটজনকে অপ্রাপ্য বা অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, যোগ্যজনকে তার ন্যায্য সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করাও গুরুতর দুর্নীতি। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করাও বড় ধরনের দুর্নীতি। কারো ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতি। দুর্নীতির এই রূপটি দুর্নীতির সংস্কৃতি লালন এবং সমাজকে ভেতর থেকে ক্ষয় করার জন্য দায়ী।

বিপুল জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ, সুশিক্ষার অভাব, নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মানসিকতা, দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং দুর্বল স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা কারণে, দুর্নীতি বাংলাদেশেও একটি ভয়াবহ সমস্যা। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতির অস্তিত্ব রয়েছে।

রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে শুরু করে পারিবারিক স্তর, এমনকি ব্যক্তি জীবনেও ঢুকে পড়েছে দুর্নীতি। তাই তো নানা কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পরিবার ও সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতার খবর শুনতে পাই। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশে এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।

তবে একদিনে দুর্নীতি এ অবস্থানে আসেনি। স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ দুটি সামরিক স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে ক্ষমতাই ছিল সবকিছু।

তখন তারা দেশবাসীর সম্মুখে এমন একটি অবিচার অনাচারপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল যেখানে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা যায়, গণমাধ্যমে সেকথা সগর্বে প্রচারও করা যায়, খুনিদের স্বীকারোক্তি পরও তাদের বিচার করা যায় না, প্রয়োজনে আইনি বিচার ঠেকাতে সংবিধান সংশোধন করা যায়, কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দিয়ে খুনিদের পুরস্কৃত করা যায়, এমনকি খুনিরা রাজনৈতিক দলও খুলতে পারে। অর্থাৎ ক্ষমতাবানদের ইচ্ছাই হলো সব, আইন আদালত সংবিধান কোনো  ব্যাপারই না।

দুর্নীতি যখন ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তখন তার ফলাফল হয় মারাত্মক ও ভয়াবহ। তাইতো নিকট অতীতে (২০০১-২০০৫) দুর্নীতি বিষয়ক জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশের এই অবস্থান ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক।

এই সময় দুর্নীতি এমন সর্বব্যাপী ছিল যে, দুর্নীতিদানবদের কালো থাবায় সমাজজীবন ছিল অতিষ্ঠ। তখন দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে একে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল।

ক্রমান্বয়ে এর শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে বিশাল মহীরুহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার শিকড় বহু গভীরে বিস্তৃত হয়ে দৃঢ়তা লাভ করে। এ অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিলেনে এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী নেতৃত্ব দিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন।

বিগত কয়েক বছর, বিশেষ করে গত এক দশকে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাস এবং উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প রচনা করেছে ৷ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষজ্ঞগণের মতে এই চলমান উন্নয়ন ও অগ্রগতি টেকসই করার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতিকে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দুর্নীতি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট নয়। দুর্নীতি দেশের সব অর্জন এবং জাতীয় উন্নয়নের সব প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিতে পারে। এ কালব্যাধির করালগ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠতে পারে অনিশ্চিত। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্নীতির কালো হাত নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। বস্তুত এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যেখানে অবস্থান করছে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা গেলে অতি দ্রুত সেই অবস্থান আরও অনেক উপরে উঠে যাবে, সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ তথা সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ বিকাশের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সামাজিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব জাগ্রত না হলে কেবল দুর্নীতি দমন কমিশনের একার পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়।  বর্তমান সমাজে দুর্নীতির অবস্থান এতটাই শক্তিশালী যে দুর্নীতি দমন কমিশনে দুর্নীতিসংক্রান্ত হাজার হাজার মামলা ঝুলে আছে।

রাজনীতিবিদ, আমলা, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সমাজের যারা অগ্রবর্তী অংশ হিসেবে বিবেচিত, তাদের সবাই না হলেও, একটি বৃহৎ অংশ আজ নৈতিকতাহীন আদর্শচ্যুত এক কলুষিত জীবনযাপন করছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ বারের মত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। চলতি মেয়াদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কার এবং দেশ পরিচালনায় কিছু ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’।

দুর্নীতি দমন করে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সকল সুযোগ এবং সম্ভাবনার সকল দ্বার উন্মোচিত করতে শেখ হাসিনার সরকার বদ্ধপরিকর। দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থানে আগে থেকেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন উদ্যোগ, কঠোর আইন কানুন কৌশল প্রণয়ন করেছেন মাঠ পর্যায়ে দুর্নীতি দমনের জন্য।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বেশকয়েকবার দেশজুড়ে চলেছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। ছাড় দেয়া হয়নি প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকে ৷ দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছিল কঠোর ব্যবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ দেশের গণমানুষ ও সুশীল সমাজের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর মতে, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন খুবই জরুরি। তবে এই কঠিন লক্ষ্যে সফলতা অর্জনে শুধু কঠোর আইন ও প্রবিধান প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, সাথে প্রয়োজন দুর্নীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা।

দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ যেমন মুখ্য তেমন তা বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে জনগণেরও সচেতনতা এবং সক্রিয়তা প্রয়োজন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ যত সচেতন হবে, দুর্নীতি ক্ষেত্র ততই সংকুচিত হবে।

জনগণ এবং রাজনীতিবিদরা যদি সত্যিকারের এবং সম্মিলিতভাবে চান যে বাংলাদেশ এই মুহূর্ত দুর্নীতিমুক্ত থাকবে, তাহলে তারা তা অর্জন করতে পারবেন এবং সেটাই সর্বাগ্রে জরুরি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে তৃণমূল পর্যায়ে সকলকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।

আমরা যদি আমাদের শুভবুদ্ধি, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারি তবেই ২০৩১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের কাতারে নিয়ে যাওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।  

লেখক: পরিচালক, আইকিউএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।