পলাশ আহসান
জাতীয় সংসদ নির্বাচন গেলো। এখন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আলোচনা সামনে আসছে। যথারীতি আমাদের বিএনপি বন্ধুরা না না করছেন। আর আমার বার বার মনে পড়ছে ছক্কা সয়ফুর এবং কৃষক মোহাম্মদ সাদেকের কথা। দু’জনেই নির্বাচন পাগল মানুষ ছিলেন। নির্বাচনের খবর পেলেই তারা সেখানে হাজির হতেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্যন্ত অংশ নিয়েছিলেন তারা দুজনেই। তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়াটা তখন ছিল নির্বাচনী জোকসের মত। সেসময় নির্বাচনের মত একটা জটিল বিষয়ের মধ্যে খানিকটা রসালো উপাদান ছিল ছক্কা সয়ফুর এবং কৃষক মোহাম্মদ সাদেককে।
সারাদেশের মানুষের সঙ্গে কৃষক মোহাম্মদ সাদেককে আমিও চিনতাম। ঢাকায় এসে আলাদা করে চিনলাম ২০০১ সালে। আমার অফিস তখন মালিবাগে। তাঁর কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের অফিসটাও কাছাকাছি। প্রায়ই দেখতাম ভদ্রলোক একটা পত্রিকা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছেন। একদিন পরিচিত হয়ে, জিজ্ঞেস করলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়েন কেন? উত্তর না দিয়ে আমার পরিচয় নিলেন। বললেন একদিন তার অফিসে যেতে।
তার অফিসে গিয়ে দেখলাম সেটা অফিস এবং বাসা। সেদিন অনেক কথা বললেন। তাঁর স্বপ্নের কথা জানালেন। বললেন ২৭ বছর বয়স থেকেই তিনি নির্বাচন করছেন। এখন বয়স ৭০ এর উপরে। কখনও জয়ী হননি। কিন্তু শুধু তাঁর কারণেই অনেক জায়গায় নির্বাচন করতে হয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জেতার জন্যে অনেকে টাকা দিতে চেয়েছে। তিনি কখনও বিক্রি হননি। কারণ তিনি মনে করেন আমাদের মত দেশে সুশাসন নির্ভর করে নির্বাচনের ওপর। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পর একটি দেশে নির্বাচন ছাড়া যোগ্য নেতা নেতা নির্বাচনের আর কোন পথ থাকে না।
আরেকজন এরকম নির্বাচন পাগল ছক্কা ছয়ফুর। তার সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু পত্রিপত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায় তিনি পেশায় বাবুর্চি ছিলেন। কাজ না থাকলে নিজের খরচ চালানোর জন্যে ঠেলা গাড়িও চালাতেন। নিজস্ব স্টাইলে বক্তৃতা করতেন। ১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে জিতেও গিয়েছিলেন। এরপর বহু নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছেন। কিন্তু জিততে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। তিনিও বার বার বলেছেন শুধু জয়ী হতে মানুষ নির্বাচন করে না। হারার জন্যেও কাউকে কাউকে নির্বাচন করতে হয়। একতরফা নির্বাচন হতে দেয়া দায়িত্বশীল আচরণ নয়।
কথা শুরু করেছিলাম উপজেলা নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু বললাম দু’জন নির্বাচন পাগল মানুষের কথা। অনেকে ভাববেন ধান ভানতে শিবের গীত। কিন্তু আজ যারা নির্বাচন শুনলেই না না করেন তাদের জন্যে তারা দু’জন খুবই শিক্ষনীয় উদাহরণ হতে পারেন। তারা প্রত্যকেই জীবনভর ৪০টির বেশি নির্বাচন করেছেন। প্রায় জেতেননি বলা যায়। কিন্তু নির্বাচনী হাল ছাড়েননি। তাদের সময়ের নির্বাচন নিয়ে যে অভিযোগ ছিল না তা নয়। কঠোর ভাষায় সেসব অভিযোগের কথা তারা মানুষকে জানিয়েছেন এবং আবারও নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তারা কথায় এবং কাজে বার বার প্রমান করেছেন, নির্বাচন নিয়ে যত সমালোচনাই থাক, একে সব সময় হ্যাঁ বলতে হবে।
কিন্তু আমাদের বিএনপির বন্ধুরা সেই ২০০৮এ নির্বাচনে হারার পর থেকেই নির্বাচন বিমুখ হয়ে আছেন। ২০০৮ এর নির্বাচনেও আসতে চাচ্ছিলেন না। তখনকার সারাদেশের নেতৃত্ব অনেক বুঝিয়ে এবং শর্ত মেনে তাদেরেকে নির্বাচনে এনেছিল। কারণ ততদিনে ৩ মাস মেয়াদের তত্ত্বাবধায়কের বয়স আড়াই বছর হয়ে গেছে। সেই অচলায়তন ভাঙতে উদগ্রীব ছিল সবাই। সেই আড়াই বছরের বিরক্তির জেরে ওই পদ্ধতিকে তখনই না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রায় সবাই।
কিন্তু বিএনপি জামায়াতের ঝুলিতে ছিল ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়ের অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার আলেকে তারা চাইছিল হাজারো মিথ্যার মিশেলে একটা জোয়ার তুলে সেই জোয়ারে নেয়ে উঠতে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর মরণপণ এজেন্ডা তো ছিলই। যে কারণে তাদের দরকার হচ্ছিল ওই রকম একটা দীর্ঘ তত্বাবধায়ক। সে অনুযায়ী সব প্রস্তুতিও নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু তাদের কোন পরিকল্পনাই কাজে আসেনি। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়কে ফেরেনি। ২০১৪ সালে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন হয় এবং যথারীতি আওয়ামী লীগ সরকারে আসে। ২০১৮ সালেও না না করতে করতে বিএনপি নির্বাচনে এসেছিল। কিন্তু ভোটারের কাছে যায়নি। প্রচার করেনি। বলেছিল তাদের বাধা দেয়া হচ্ছে। ৩২ ভাগ ভোটারের একটি বড় রাজনৈতিক দলকে কীভাবে বাঁধা দিয়ে আটকে রাখা যায় সে ব্যাখ্যা অবশ্য দেয়নি।
২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে এসেছিল বিএনপি। ৪ দফা নির্বাচনের প্রথম তিন দফার ফলাফলে বিএনপিই এগিয়ে ছিল। জামায়াতও জিতেছিল বহু এলাকায়। কিন্তু সে ইতিহাস তারা কেউ মনে রাখেনি। এবার জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে তাদের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করছেন। বিন্তু তৃণমূলের কর্মীরা বরাবরের মত গণমাধ্যমের কাছে তাদের নির্বাচনে আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন।
পত্রপত্রিকায় বিএনপির বেশিরভাগ কর্মীর মত, দলের সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক রাখতে হলে শক্ত নেতৃত্ব দরকার। সরকারের বিভিন্ন ফোরামে কথা বলার জন্যে হলেও নিজেদের দলীয় লোক দরকার। কারণ কথা বলার সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় সংসদে তার দলের কেউ নেই। এখন স্থানীয় সরকারেও যদি না থাকে তাহলে তাদের কথা মানুষ জানবে কীভাবে? হাটে, মাঠে, ঘাটে, চায়ের দেকানে কথা বলে আর কতদিন টিকে থাকা যাবে?
যেকোন পদ্ধতিতে হোক বিএনপির মধ্যে নির্বাচনেচ্ছু এই অংশটি নেহায়েত ছোট নয়। এদের প্রত্যকের ভোটারদের মধ্যে শক্ত অবস্থান এবং আস্থা আছে। যে কারণে তারা এরকম মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। তারাই গণমাধ্যমে বারবার বলেন, যারা শুধু ঢাকায় অথবা দেশের বাইরে বসে রাজনীতি করেন তারাই এমন জনগণ বিচ্ছিন্ন কথা বলতে পারেন। এসব নেতারা অবশ্য নিজের নাম প্রকাশ করে বলেন না। কারণ তারা জানেন নির্বাচনের পক্ষে কথা বললেই এখন বহিস্কারের রেওয়াজ বিএনপিতে।
সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচন আইন সংশোধনের প্রসঙ্গ এসেছে। বলা হচ্ছে এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকবে না। দেশের প্রায় সব নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এই সিদ্ধান্ত স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলছেন এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বেশি ভোটের সরকার বিরোধী প্রার্থীরা। কারণ হিসাবে তারা যেটা বলেন সেটা হচ্ছে, সারাক্ষণ না না অনুভূতির নেতারা এখন নিজেদের মত নির্বাচন করতে পারবেন। দলীয় ভাবমূর্তি ব্যক্তিগত কাজে লাগাতে পারবেন। কারণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকায় তারা ভোটারের সহানুভূতি। সরকারি দলেরর প্রতি ক্ষুব্ধ শেণির ভোট একত্র করতে পারবেন। কিন্তু দলের প্রতীক ব্যবহার করতে হবে না। দলীয় একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকলেও কাউকে দলের সিদ্ধান্তে সরে দাঁড়াতে হবে না। আবার তাদের বিরোধীরাও প্রতীক না থাকার সুযোগে নানা প্রতীকে ভাগ হবেন। ফলে যার ভোট বেশি তারই জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
এত সম্ভাবনার পরেও বিএনপি নেতারা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে এখনও ইতিবাচক নন। অথচ দলের তৃণমূলের দাবি শুধু উপজেলা নির্বাচনেই ৪৯৫ এলাকায় দেড় হাজার পদ। এর অন্তত অর্ধেক যদি জয় করা যায় তাদের দলীয় অবস্থান অনেক শক্ত হবে। নির্বাচন কেন্দ্র করে দলীয় সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত হবে। জয়ী হওয়া যাবে জেলা পরিষদ নির্বাচনেও। পদধারী বহু নেতা যখন সরকার বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হবে তখন সেই আন্দোলনের গতি বাড়াতে মিয়ান আরেফি কিম্বা হাসান সরোয়ার্দীর মত লোকজন ভাড়া করতে হবে না।
সম্প্রতি একজন নির্বাচন কমিশনার ঘোষণা দিয়েছেন উপজেলা নির্বাচন হবে চার ধাপে। ফলে তারা সেই নির্বাচনে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারবেন। খুঁটিনাটি বহু সুক্ষ্ম অনিয়ম ধরে ফেলে যাবে দ্রুত। নিরাপত্তাসহ অন্যান্য খাতে আরও বেশি লোকবল নিয়োগ করা যাবে। ফলে কোন বেশি ভোটের প্রার্থীর হেরে যাওয়ার শঙ্কা থাকবে না। তাই কৃষক মোহাম্মদ সাদেক এবং ছক্কা সয়ফুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলা যায়, নির্বাচনে অংশ নেয়া এখন দেশের কাজ। এখানে এখন হ্যাঁ বলার সময়। না বললেই পিছিয়ে পড়তে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।