অমিত দত্ত

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আর মহামারি পরবর্তী সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটার ফল হিসেবে চলতি বছরের প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভুগতে হয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে ডলার সংকটে আমদানি এবং ব্যাংকিং খাতেও রয়েছে নানামুখী সংকট।

একই সাথে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও ই-কমার্স খাতের অনিয়ম নিয়েও বছর জুড়ে রয়েছে নানা ধরনের আলোচনা। অর্থনীতির একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে আমরা ২০২৪ সালে প্রবেশ করেছি।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে গত বছরে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল আট দশমিক ৯১ শতাংশ। কিন্তু এ বছর কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে রপ্তানি বাজারের কথা মাথায় রেখে টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে তা একবারে সমন্বয় করা সম্ভব হলে প্রবাসীদের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি হতে পারে।

নির্বাচনকালীন সময়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমলেও জানুয়ারিতে এসে সেটি গত দুই বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবার জানুয়ারিতে রেকর্ড ৫৭২ কোটি ৪৭ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। কোনো কোনো ব্র্যান্ড ও ক্রেতা সাড়া দিয়েছে, পোশাকের মূল্য বাড়িয়েছে। সেটাও রপ্তানি আয় বাড়ার একটি কারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই–সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি বাবদ মোট আয় ফলে এ খাতের মোট রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৮২২ কোটি ডলারে, যা এ খাতের মোট আয়ের প্রায় ৭১ শতাংশ।

অথচ ২০২২–২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ২৭ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি বাবদ ব্যয় ছিল ৪৯৮ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ খাতে প্রকৃত রপ্তানি আয় ছিল ৫২৯ কোটি ডলার, যা মোট আয়ের সাড়ে ৫১ শতাংশ।

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, করোনার পর থেকে বিশ্ববাজারে নিট পোশাকের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এমনকি করোনাকালেও নিট পোশাকের চাহিদা ছিল অনেক বেশি। কারণ, করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময় দেশে দেশে লকডাউন জারি করা হয়।

স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঘরের বাইরে পরার পোশাকের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। বিক্রি না থাকায় বিদেশি ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেন।

অন্যদিকে ঘরে পরার নিট পোশাকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিও বাড়তে থাকে। নিট পোশাক বলতে সাধারণত গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি পোশাকই বোঝায়। যেমন টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টস প্রভৃতি। অন্যদিকে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম প্রভৃতি ওভেন পোশাক ইত্যাদি।

গত জুলাই–সেপ্টেম্বরে দেশের তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশই এসেছে মাত্র নয়টি দেশ থেকে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রয়েছে যথাক্রমে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও কানাডা।

এ সময়ে এ নয়টি দেশ থেকে পোশাক রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৮১১ কোটি ডলার। এর থেকে বোঝা যায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রর বাজার আরও ভাল হয়েছে।

এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ও  কূটনৈতিক  সম্পর্ক  আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যা অব্যাহত রাখা গেলে অর্থনীতির পথ আরও সুগম হতে পারে। ফলে সামনের দিনগুলোতে ডলারের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন ইশতেহারে বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের কাতারে নিয়ে যাওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। দেশে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, আমাদের যে কাজ করতে হবে সেটি হচ্ছে, দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে এক ধরনের যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে সেটি কাটিয়ে উঠতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ডলার এক্সচেঞ্জ খাত ও সুদহার নীতিতে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। এ অবস্থায় বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা আমাদের জন্য দুষ্কর হবে। অন্যদিকে আমাদের ইতিবাচক যে দিকগুলো রয়েছে সেক্ষেত্রেও কাজ করতে হবে।

আমাদের যেসব নন-স্টপ সেবা রয়েছে সেগুলো শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে যদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হব। এর পাশাপাশি প্রণোদনা ও সুযোগসুবিধা বাড়ানো গেলে বৈধভাবে ডলার পাঠানো সম্ভবপর হলে রিজার্ভ আরও বাড়বে।

এই ডলার প্রবাহ অব্যাহত রাখা গেলে বাংলাদেশ এর যে মিশন ও ভিশন রয়েছে তার  বাস্তবায়নও বেশ তরান্বিত হবে। সর্বশেষ এটা বলে শেষ করতে চাই যে,  স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে।

ন্যায্য, সত্য ও মানুষের কল্যাণের পক্ষে সোচ্চার বর্তমান সরকার ২০৪১ বিনির্মাণের যে ভিশন ঘোষণা করেছেন তাতে শক্তি, সাহস, সক্ষমতা ও প্রেরণা জুগিয়ে চলছে  ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির মাধ্যমে সরকারের মিশন ও ভিশনকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

অমিত দত্ত

প্রভাষক, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়