নীলফামারীর যেসব স্থাপত্যশৈলী এখনও মানুষকে বিমোহিত করে তার মধ্যে অন্যতম নয়নাভিরাম মোঘল আমলের মসজিদগুলো। এসব মসজিদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এর মধ্যে জেলা শহরের কেন্দ্রীয় বড় মসজিদ, সদরের আঙ্গারপাড়া বড়বাড়ি জামে মসজিদ, কিশোরগঞ্জ উপজেলার চাঁদ খোশাল মসজিদ বা চাঁদ খাঁ মসজিদ, জলঢাকা উপজেলার সিদ্বেশ্বরী তিন গম্বুজ মসজিদ, শেখপাড়া জামে মসজিদ ও সৈয়দপুরের চিনি মসজিদকে মোগল সাম্ম্রাজ্যের অবকাঠামো এবং আধুনিক স্থাপত্যশিল্প হিসেবে ধরা হয়। এগুলো মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক নির্দশন। তবে কালের বিবর্তনে সংস্কারের অভাবে সৌন্দর্য ও অবকাঠামোগত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এসব স্থাপনা। এগুলো দ্রুত সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মসজিদটি ঠিক কত বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো থাকায় এটিকে মোঘল আমলের মসজিদ বলা হয়। নির্মাণশৈলীর কারণে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন মসজিদের মূল অংশের সামনে আছে পাঁচটি গম্বুজ। চারদিকে চারটি এবং মাঝখানে একটি। গম্বুজের চারদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চার মিনার। গম্বুজগুলো ইট, চুন ও সুরকি দিয়ে নির্মিত। এগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করতে ওপরে বসানো হয়েছে বাহারি রঙের চিনা মাটির টুকরো। কালের পরিক্রমায় গম্বুজগুলোতে দেখা দিয়েছে ফাটল। চার মিনারের একটি ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। এ অবস্থায় ভয় ও আতঙ্কে নামাজ আদায় করতে হয় স্থানীয়দের।
মসজিদের মুসল্লি শহরের সবুজপাড়া এলাকার ইয়াসিন আলী (৯০) বলেন, ‘মসজিদটি ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা সম্ভব নয়। বাপ-দাদার আমল থেকে দেখছি। অন্যরকম মসজিদ এটি। তবে কিছু অংশে ফাটল দেখা দেওয়ায় ভয়ে ভয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। এটি সংস্কারের দাবি জানাই। সংস্কার না করলে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তখন এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি হারিয়ে যাবে।’
স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনের পাশাপাশি রহস্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে এটি। সদরের কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের আঙ্গারপাড়া বড়বাড়ি মসজিদ নামে পরিচিত। এর নির্মাণ সম্পর্কে কারও পরিষ্কার ধারণা নেই। তিন গন্বুজের মসজিদটিতে আছে আট মিনার। তিন ফুট দৈর্ঘ ও দুই ফুট প্রস্থের তিনটি দরজা আছে। মাঝের দরজার ওপরে পাথরে খোদাই করা আরবি লিপি।
মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ওতেই সম্ভবত লেখা আছে মসজিদের ইতিহাস। তবে নামফলকটি পুরোনো ও ক্ষয়ে যাওয়ায় কী লেখা আছে, তা পড়া যায় না। ২৪ বছর ধরে মসজিদের খেদমতে আছি। কিন্ত কারও মুখে শুনিনি এটা কে বা কত সালে তৈরি হয়েছে।’
মুসল্লি আব্দুল মজিদ বলেন, ‘নামফলক পড়ে দেখেছি। তাতে আরবি ৬১৬ হিজরি লেখা আছে মনে হয়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৮ ফুট ও প্রস্থ ৯ ফুট। ইটের পুরু ২ ইঞ্চি, লম্বায় ১০ ইঞ্চি। একটি নাম কোনও রকম বোঝা যায়, মাহমুদুল্লাহ হাসান। মসজিদের সামনে আছে দুটি কবর। অনেকে বলেন, কবর দুটি এক দম্পতির। কবরের ইটের মাপ, রঙ ও নকশা এক হওয়ায় ধারণা করা হয় তারাই প্রতিষ্ঠাতা।’
তিনি আরও বলেন, ‘মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন থাকায় এটিকে মোঘল আমলের মসজিদ বলা হয়। ২০০১ সালে স্থানীয়দের সহযোগিতায় একটি পাকা কক্ষ নির্মাণ করে পুরোনো মসজিদের সঙ্গে যুক্ত করে ছয়টি সারি বাড়ানো হয়। এখন সেখানে দেড়শ জনের মতো নামাজ আদায় করতে পারেন। নামফলক হিসাবে মসজিদটির বয়স ৮০০ বছরই হয়ে থাকলে, তবে প্রাচীনতম মুসলিম সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এটি।’
কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের ভেড়ভেড়ি গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন চাঁদ খোসাল মসজিদ। প্রায় ৫০০ বছর আগে নির্মিত। সংস্কারের অভাবে স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে মোঘল আমলে নির্মিত এই ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৫০০ বছর আগে ভেড়ভেড়ি গ্রামের তৎকালীন জমিদার সূর্য আলহাজ চৌধুরীর চাঁদ এবং খোসাল চৌধুরী নামে দুই ছেলে ছিলেন। চাঁদ চৌধুরী এবং খোসাল চৌধুরী মসজিদটি নির্মাণ করেন। সেই থেকে নামকরণ হয় চাঁদ খোসাল মসজিদ। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের অবকাঠামোর দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট, প্রস্থ ১০ ফুট এবং উচ্চতা ৫০ ফুট। চিটাগুড়, চুন, ইট, সুরকি এবং পোড়ামাটি দিয়ে নির্মিত। তবে সংস্কার এবং পরিচ্ছন্নতার অভাবে সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে।
মসজিদের খাদেম আফান উদ্দিন বলেন, ‘চাঁদ এবং খোসাল দুই ভাইয়ের মধ্যে চাঁদ চৌধুরী নিঃসন্তান হওয়ায় উভয় ভাই তৎকালীন সময়ে মসজিদের জমি ওয়াকফ করেন। যার পরিমাণ মোট ১৪৭ একর। ওয়াকফ অনুযায়ী, মসজিদের অবকাঠামোর মধ্যে ২ একর ৫২ শতক জমি থাকলেও বর্তমানে ২৫৫ দাগে অবকাঠামো রয়েছে ১৩ শতাংশে এবং ৩৯৯ দাগে ২৮ শতাংশ জমিসহ (পুকুর) মসজিদের দখলে আছে মোট ৪১ শতাংশ। বাকি জমিগুলো অন্যদের দখলে। মসজিদটি সংস্কার করে জমিগুলো উদ্ধারের দাবি জানাই।’
জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে মুঘল আমলের তিন গম্বুজ এবং ১২ মিনার বিশিষ্ট মসজিদটি অবস্থিত। সদর উপজেলা থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে এটি। দৈর্ঘ্য ১৫ হাত, প্রস্থ তিন হাত। তিনটি গম্বুজ ১৫ ফুট ও ১২টি মিনার ১৫ ফুট উঁচু। দেয়ালের ওপরের দিকে ফুল ও লতা গুল্মের ছবি আঁকা। দেয়ালে ইট, চুন ও সুরকির গাঁথুনি। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি দেখতে আসেন অনেক দর্শনার্থী। আকারে ছোট হলেও মূঘল সাম্রাজ্যের কারুকার্য খচিত নকশা ও গম্বুজগুলো অন্যরকম। দেয়ালে দরজার ওপরে আরবি হরফে কিছু লেখা আছে, তবে তা অস্পষ্ট। এলাকাবাসীর দাবি, এটি মুঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেব আমলে তৈরি মসজিদ। তবে সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এই স্থাপত্য।
মসজিদটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে সিদ্ধেশ্বরী গ্রামের বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। চুন ও সুরকি খসে পড়ছে। সৌন্দর্যের অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবি জানাই। এতে মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের আগমন বাড়বে। মসজিদটি এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে, সরকারিভাবে সংস্কারের দাবি আমাদের। এখন ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে একদিন হারিয়ে যাবে এই ঐতিহ্য।’
জেলা শহর থেকে মসজিদটি দেখতে আসা মো. আব্দুর রহিম বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে, দেয়ালে পলেস্তারা খসে পড়ছে। সংরক্ষণ ও সংস্কার করলে মানুষজন নিয়মিত নামাজ পড়তে পারবেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দর্শনার্থীদের দেখার ইচ্ছে পূরণ হবে।’
অপূর্ব স্থাপত্যের নির্দশন হিসেবে পরিচিত মোঘল আমলের এই মসজিদ। এটি সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের গোড়গ্রামে অবস্থিত। জানা যায়, ১৭৮৮-৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মোহাম্মদ জারিফ নির্মাণ করেছিলেন। এটির দৈর্ঘ্য ১৫ দশমিক ৮ মিটার ও প্রস্থ ছিল ৫ মিটার। সামনের দেয়ালে একটি শিলালিপি স্থাপিত আছে। শিলালিপিতে সাত সারির ফরাসি পঙক্তিমালা লেখা।
১৯৫৩ সালে মসজিদের একটি গম্বুজ নষ্ট হওয়ায় ১৯৬০ সালে নতুন মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যে পুরাতনটি ভেঙে ফেলা হয়। পুরোনো মসজিদটির নকশার ওপরে আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়। দক্ষিণ পাশে প্রাচীন স্থাপনা এখনও দাঁড়িয়ে আছে; যা হুজরাখানা নামে পরিচিত। হুজরাখানার চার কোণে চারটি গোল আকৃতির কর্নার আছে। যা মোঘল স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা দর্শনার্থী শেফায়েত মিয়া ও জেমি আক্তার জানান, মসজিদটি দেখতে অনেক সুন্দর। তাই দেখতে এলাম। মোঘল আমলের হওয়ায় নকশাগুলো অপূর্ব।
সৈয়দপুরের প্রাচীন সৌন্দর্যের স্থাপত্য নিদর্শন চিনি মসজিদ। যা অনেকের কাছে চীনা মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। নীলফামারী সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এটি। ১৮৬৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামের দুজন ধর্মপ্রাণ সৈয়দপুর শহরের ইসবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথমে নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় তা টিনের ঘরে রূপান্তরিত হয়। পরে এলাকার লোকেরা মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে ফান্ড গঠনে উদ্যোগী হয়। এরপর শুরু হয় নির্মাণকাজ।
মসজিদটি ইট ও সুরকি দিয়ে নির্মিত। দেয়ালের ওপর চিনামাটির থালার ও কাচের ভগ্নাংশ বসিয়ে কারুকাজ করা হয়েছে। পদ্ধতিটি চিনি করা বা চিনি দানার কাজ করা বলে নাম দেওয়া হয়েছে চিনি মসজিদ। সৌন্দর্যের কাজে ব্যবহৃত চিনামাটির উপকরণসমূহ আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। ঐতিহাসিক এই মসজিদের নকশা করেন মো. মোখতুল ও নবী বক্স। দেয়ালে অঙ্কিত ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, একটি বৃত্তে একটি ফুল, চাঁদতারাসহ নানা চিত্র রয়েছে। তৈরিতে প্রচুর মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। ২৭টি মিনার রয়েছে। ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর আছে। রয়েছে ছোট ছোট ৩২টি মিনারসহ তিনটি বড় গম্বুজ। একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। এর সৌন্দর্য দেখতে দেশ-বিদেশের প্রচুর পর্যটক আসেন।
মোঘল আমলের মসজিদগুলো সংস্কারের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘এসব মসজিদ শুধু ইতিহাস ও ঐতিহ্য নয়, বরং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক প্রতীক। প্রত্নতত্ব বিভাগ প্রাচীন স্থাপনাগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। তারা যদি আমাদের সহযোগিতা করে কিংবা সংস্কার করতে বলে তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’