বাংলাদেশের নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে আরব নিউজ বলেছে, এ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা স্থায়ী কোনো চিহ্ন রাখবে না। তবে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা দক্ষিণ এশিয়ায় চরমপন্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা মধ্যপন্থি দেশগুলোর উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
আরব নিউজ ‘বাংলাদেশের গতিশীল উল্লম্ফন, শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পঞ্চম মেয়াদ’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। পেন্টাগন বিষয়ক বিশ্লেষক ওবাই শাহবান্দার এবং আন্তর্জাতিক নীতি বিশ্লেষক অ্যাডেলে নাজারিয়ান যৌথভাবে এ বিশ্লেষণ লিখেছেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, বাংলাদেশ এখন ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। আর এর ফলেই বিশ্বের প্রভাবশালী সব দেশ এখন বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচন ঘিরে সমালোচনা আর আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনকে এখন মূলত নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে যে- তারা বাংলাদেশ ও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ফিরে আসাকে উৎসাহিত করতে চায় কি-না?
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে, বাংলাদেশের মতো কৌশলগত আঞ্চলিক উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো মার্কিন বলয়ের বাইরে সম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগী হতে পারে বলেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের ভুল হচ্ছে এবং তা সমালোচনার মুখে পড়েছে বলেও আরব নিউজের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি এখানে তুলে ধরা হলো:
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা পঞ্চম মেয়াদে জয়ী হওয়া বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথে একটা বড় পদক্ষেপ। তবে কোনো দেশের গতিশীল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অস্বস্তিকরভাবে দুটো বিষয়ে প্রশ্ন এসেই যায়। তা হলো- আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার ভবিষ্যৎ। কারণ, বিভিন্ন দেশের বিরোধপূর্ণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে এবং প্রত্যেকেই এখানে (বাংলাদেশ) নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদের নারী সরকারপ্রধান হলেন শেখ হাসিনা, যিনি গত সাত জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পঞ্চমবার এবং টানা চতুর্থবারের মতো আরো পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জন্য শপথ নিয়েছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, যার নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত দেশটিকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু চার বছর পর একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সঙ্গে স্বাধীনতার জনককে হত্যা করা হয়েছিলো। দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।
১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার দায়িত্ব পালনের সময়ে বাংলাদেশ এমন একটি অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, যা দেখে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ‘অলৌকিকের চেয়ে কম কিছু না।’
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে, যার অন্যতম প্রমাণ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী সম্প্রসারণ এবং চীন ও আরব বিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসাবে তার অবস্থানকে আরো মজবুত করছে, যে রপ্তানির প্রাথমিক বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের মিত্রদের নিয়ে দক্ষিণ চীন সাগর ও বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। আর এর ফলেই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের কৌশলগত তাৎপর্যকে বাড়িয়ে তুলছে, যার ফলশ্রুতিতে জাপানের অর্থায়নে বঙ্গোপসাগরে (মাতারবাড়ি) একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে।
এই বন্দর শুধু যে বাংলাদেশেরই মেরিটাইম সক্ষমতা বাড়াবে তা নয়, বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। আর আঞ্চলিক সংযোগের ক্ষেত্রেও এই মাতারবাড়ি বন্দর একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে অবতীর্ণ হবে। আর এখানে গতিশীলভাবে বিকশিত হওয়া ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি সম্ভাব্য ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে এই বন্দর।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রতিক্রিয়া অন্যদের থেকে একেবারেই ভিন্ন। প্রতিক্রিয়ার এই ভিন্নতার কারণে আগামী দিনে বাংলাদেশের মানুষ ওয়াশিংটনকে কীভাবে দেখবে তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
আর এর ফলে, মার্কিন বলয়ের বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। এমন এক সময়ে এই ঘটনা ঘটছে, যখন তাইওয়ান প্রণালি ও দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। আর এই উত্তেজনা নিশ্চিতভাবেই এই অঞ্চলকে ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ফলে বাংলাদেশের মতো দেশের সঙ্গে বৃহৎ শক্তিগুলোর সম্পর্ক কেমন হবে, তা দিন দিন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন যে, তাদের দেশের প্রতি আমেরিকার অপ্রয়োজনীয়, পক্ষপাতদুষ্ট ও শক্ত নীতি দেখে উদ্বিগ্ন ও হতাশ তারা।
বিএনপির বয়কট সত্ত্বেও, ৪০ শতাংশ ভোটারদের উপস্থিতি ছিলো সম্মানজনক। আরব পার্লামেন্ট ও অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশনসহ বা ওআইসিসহ ৪০টিরও বেশি দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অপ্রতিরোধ্য ঐকমত্য ছিলো যে, নির্বাচন কমিশন একটি স্বচ্ছ ভোটদান প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেছে।
পুনরায় বিজয়ী হওয়ায় শেখ হাসিনাকে দ্রুত অভিনন্দন জানিয়েছে চীন ও ভারত, যা ভোটের বৈধতাকে সমর্থন করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুটি দেশ বাংলাদেশের একাধিক মেগাপ্রকল্পে অর্থায়নের প্রধান উৎস। দেশ দুটিকে সঙ্গে রাখা শেখ হাসিনা প্রশাসনের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
টানা বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের বাঙালির ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরা নৌকার একটি রেপ্লিকা উপহার দেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত, এই নৌকা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক। আর শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রতিবেশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থায়ী ও জনকেন্দ্রিক অংশীদারিত্বকে আরো শক্তিশালী করতে তার দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশের একমাত্র নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অর্থায়নকারী রাশিয়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
আর এর উল্টো পথে হেঁটে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করেছে যে, অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সাথে তারা একমত যে, এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না এবং সমস্ত দল অংশ নেয়নি।
এর ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর সীমিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং শেখ হাসিনার প্রশাসনের কয়েকজনকে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার’ জন্য অভিযুক্ত করেছে।
তবে, বাংলাদেশের জন্য বাইডেন প্রশাসন নতুন করে একটি সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে। আর তা হলো, যখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষাসহ একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, তখন তারা বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে একটি বড় ভুল করছে।
অনেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন যে, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার কারণে গুরুতর সহিংসতা বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্বাচন শেষ হওয়া সত্ত্বেও ওয়াশিংটন অন্যায়ভাবে বাংলাদেশকে কোণঠাসা করছে।
বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে যাওয়া আলেকজান্ডার গ্রে বলছেন, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সকা আটটা থেকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমরা কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পেয়েছি যে, তারা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। আমরা কোনো দল, প্রার্থী বা অন্য কারো দ্বারা ভোটারদের ভয় দেখানোর ঘটনা বা ইঙ্গিত শুনিনি ও দেখিনি। আর ঢাকার বাইরে উল্লেখযোগ্য ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য করেছি।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত কর্মকর্তারা এবং মানবাধিকার, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলি বাইডেনকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল, যে চিঠিতে বাংলাদেশের বিষয়ে তার প্রশাসনের বর্তমান অবস্থান পুনর্বিবেচনা অনুরোধ করা হয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সহিংসতামুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আপনাকে বর্তমান কর্মপন্থা পরিবর্তন করার জন্য আমরা বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের বিবেচনা করতে হবে বলেও চিঠিতে বলা হয়।
গত বছরের ডিসেম্বরে একটি জনসভায় শেখ হাসিনা বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী’ দল হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বিএনপির মিত্র দল জামায়াতে ইসলামীকে ‘যুদ্ধাপরাধীদের দল’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।
পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব একটি ‘রূপান্তরমূলক পর্যায়ে’ পৌঁছেছে এবং বাইডেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে একুশ শতকের সবচেয়ে পরিণতিমূলক বলে বর্ণনা করেছেন।
বাংলাদেশে ২০০৫ সালে জামাতে ইসলামীর নেতৃত্বে জঙ্গি উত্থানের মুখোমুখি হয়, যার মধ্য দিয়ে ভারতের পূর্ব অংশে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আন্তঃসীমান্ত আক্রমণ চালানোর জন্য অপারেশনের একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে চেয়েছিলো।
নির্বাচনের দৌড়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশ নিয়ে যে সমালোচনা করেছে তা পুঁজি করার চেষ্টা করেছে রাশিয়া। প্রকাশ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য অভিযুক্ত করে তারা।
বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। দেশটির মানুষদের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার, যা ২০০৫ সালেও ছিলো মাত্র ৫০০ মার্কিন ডলার। এই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর্যায়ে রয়েছে।
স্বাধীন অর্থনৈতিক গবেষণা অনুযায়ী, ২০৩১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে (মাথাপিছু কমপক্ষে $৪,০০০ জিডিপি প্রয়োজন)। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দেওয়া বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে অভাবনীয় উন্নয়ন করেছে। আর এটা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে, যিনি মুসলিম বিশ্বের একমাত্র নারী নেত্রী। তিনি এমন একটি বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করেছেন যা দেখে তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা। কীভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো টেকসইভাবে লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্রের কষাঘাত থেকে বের করে আনতে পারে, সেই মডেল হিসেবে শেখ হাসিনাকে বিশ্বব্যাপী উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছ বিশ্বব্যাংক। আর অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালক হিসেবে শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক পরিবর্তনকেও তুলে ধরছেন বিশেষজ্ঞরা।
শেখ হাসিনা সম্প্রতি ২০৪১ সালের মধ্যে বিস্তৃতভাবে জাতীয় অগ্রগতির লক্ষ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামে বাংলাদেশের জন্য একটি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পপনা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের জন্য উন্নয়ন রূপান্তর অর্জন করতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে চড়া মূল্য দিতে হয়। তিনি বেশ কয়েকবার হত্যার প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। উগ্র চরমপন্থি ও জঙ্গি মতাদর্শ দমন করতে তার প্রশাসন অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলার সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়াও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদকে সমর্থন ও প্রচার করে এমন একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন।
শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক জলপথ পাড়ি দিচ্ছে, যেখানে রয়েছে প্রধান অংশীদাররা ছাড়াও রয়েছে উদীয়মান শক্তিগুলি। ভারতের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলির সাথে এবং বিশেষ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা প্রসারিত করেছে।
শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রার উন্নতির লক্ষ্য নিয়ে ১০০ পৃষ্ঠার এক ইশতেহার প্রকাশ করেছে, যার নাম ভিশন-২০৪১। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিই শেখ হাসিনার প্রধান লক্ষ্য।
তিনি বলেছেন, তার পররাষ্ট্রনীতি নিজের এবং পৃথিবীর অন্যসব দেশের স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখাকে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত। এটি তার প্রয়াত পিতার ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা।
এই মতবাদটি বৈশ্বিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে আজও প্রতিফলিত করেছে। এই নীতি মেনে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক গভীর করার ইচ্ছে প্রকাশ করে, আবার একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাপান, কানাডাসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক গভীর করার ইচ্ছেকেও সমান ভাবে ব্যক্ত করে এই নীতি।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থকেরা বিশ্বাস করেন, পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা সম্ভবত এখনো আঁচ করতে পারছে না বাংলাদেশে কী পরিমাণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। জঙ্গিরা ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিরাট এক সন্ত্রাসী হামলা চালায়। রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রে একটি ক্যাফেতে সেদিনের হামলায় বেশ কয়েকজন বিদেশিকে জিম্মি করে হত্যা করে জঙ্গিরা। এরপর গত বছরের (২০২৩) ২৮ অক্টোবর মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়ে সন্ত্রাসীদের সমর্থিত একটি দল হামলা চালিয়ে একজন পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে এবং এরপর থেকে দুই মাসে প্রায় ২০০ গাড়ি, বাস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে। এই ঘটনায় দেশটির বহু নিরীহ নাগরিক আহত হন, ভয়ঙ্করভাবে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় বহু সাধারণ মানুষকে। চরমপন্থিরা স্কুল কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার জন্য এবং রাস্তাঘাটে যান চলাচল বন্ধ রাখার দাবিতে শত শত বাসে আগুন দেয়।
মনে রাখা দরকার, আগে প্রায় প্রতিদিন এই ধরনের ঘটনা ঘটতো। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পর থেকে দেশব্যাপী চলা তাণ্ডব বাংলাদেশে জনগণকে সেইসব দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই দিনগুলি যাতে ফিরে না আসে তা নিশ্চিত করাই ছিলো নির্বাচনের আগে জনসাধারণের কাছে ভোট চাইবার জন্য শেখ হাসিনার আবেদনের মূল ভিত্তি। নির্বাচনকে ঘিরে সমালোচনা আর আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনকে এখন মূলত নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে যে- তারা কি বাংলাদেশে এবং গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা আর শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ফিরে আসাকে উৎসাহিত করতে চায় কি-না?
হাসিনা যখন গত বছরের নভেম্বরে ব্রাসেলস সফরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন ইউরোপ ও চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় তার দেশ নির্দিষ্ট কারো পক্ষ নেবে না।
কৌশলগত ভারসাম্যকে কেন্দ্রে রেখে করা একটি বৈদেশিক নীতি আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবানই করেছে। পশ্চিমের রপ্তানি বাজার আর জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করছে, অন্যদিকে চীনা নির্মাণ সংস্থাগুলিকে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি প্রদান করা হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিটিই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষকদের মতে, শেখ হাসিনার সংস্কারগুলি নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক কাজ করেছে এবং সত্যিকার অর্থেই ব্যাপকভাবে দারিদ্র্য হ্রাস করার পাশাপাশি গণ ক্ষুধা নির্মূল করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে এবং বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন- হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অধিকার ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করেছে।
বাংলাদেশ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে বিনিয়োগ করেছে। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ অতিথি বলে ডাকে, যাদের সবাই মিয়ানমারে নৃশংস জাতিগত নিধন অভিযান থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
সম্প্রতি কয়েক হাজার রোহিঙ্গার জন্য ভাসানচরে বিভিন্ন সুবিধা সম্বলিত নতুন করে চালু করা আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেখানে তারা তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আশ্রয়ে বসবাস করছে, নারীদেরকে স্বাবলম্বী করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ এমন এক সময়ে বিশাল এই মানবিক উদ্যোগ নিয়েছে, যখন মিয়ানমার ধীরে ধীরে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, সেখানে প্রতিযোগী সামরিক গোষ্ঠীগুলি উপমহাদেশের জন্য গুরুতর নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এদিকে, দেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ করা বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন যে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার বদলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর বিষয়ে মনোযোগী তারা।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির মূল বেঞ্চমার্ক, ৫২ পূরণে সময়সূচির চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের আরো সম্প্রসারণ করতে এটিকে ভিশন-২০৪১ এর একটি মূল লক্ষ্য হিসেবে রেখেছেন শেখ হাসিনা। ভারতের অশান্ত উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত থাকবে এবং দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়বে বলে আশা করা যায়।
তবে সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দুয়ার খোলা রেখেছেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ নই, খুব খোলা মনের ও উদার। বরং এটা ভালো, আমি সমালোচনা শুনতে ও শিখতে পারি।
তিনি বলেছেন, তার পররাষ্ট্র নীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত। তিনি রসিকতা করেছিলেন যে, গত সেপ্টেম্বরে ভারতে জি-২০ সম্মেলনের সাইডলাইনে তার সঙ্গে যখন বাইডেনের দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি ও তার কন্যা বাইডেনের সঙ্গে একটি সেলফি তুলেছিলেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটনের সমালোচনা স্থায়ী চিহ্ন নাও রাখতে পারে। তবে সমৃদ্ধির অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যপন্থি রাষ্ট্রগুলোকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের এই সমালোচনা একটি অপ্রয়োজনীয় প্রতিবন্ধক হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।