মো. ইলিয়াস হোসেন

২০২৪ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অধ্যায়ের ‘শরীফার গল্প-র মাধ্যমে সমকামিতাকে বৈধ করার ও ট্রান্সজেন্ডারের নামে ধর্ষণ বৃদ্ধির অভিযোগ তুলেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক। কিন্তু গল্পটি পড়লে দেখা যাবে উক্ত বইয়ের শরীফার গল্পে ‘সমকামী’ ও ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নামে কোন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি বা এসব বিষয়ের কোন ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি।

সেখানে লেখা হয়েছে “সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)।” তৃতীয় লিঙ্গ হলো যাদের নারী বা পুরুষ কোনটা দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না, যাদের মধ্যে নারী বা পুরুষ উভয়ের সম্মিলন থাকে। আমাদের সমাজে এমন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছে কিন্তু তাদের এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজ তাদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছে না।

যার কারণে সমাজের সকল স্তরে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এই বৈষম্য নিরসনের জন্য সংবিধানের ২৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না”। তাদের প্রতি বৈষম্য দূর করা এবং সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্যে ২০১৩ সালে নভেম্বর মাসে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সরকার স্বীকৃতি  দিয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয় (প্রথম আলো ১১ আগস্ট ২০১৮)।

এছাড়া ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অসচ্ছল ও অক্ষম হিজড়াদের বিশেষ ভাতা হিসেবে মাসিক ৬০০ টাকা প্রদান, স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য চার স্তরে উপবৃত্তি প্রদান, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয় বর্ধকমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই কর্মসূচির সুফল আশানুরূপ হচ্ছে না। এর মূল সমস্যা হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি আমাদের সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।

সমাজে মানবিক শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কার বৃদ্ধি। এই অবস্থা দূর করার জন্য পাঠ্যপুস্তকে ‘শরীফার গল্প’-র প্রয়োজন রয়েছে। সমাজ যেহেতু এখনো নেতিবাচক মনোভাবের মধ্যে রয়েছে সেহেতু তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টি তাদের সন্তানদের পাঠ্যপুস্তকে মেনে নিতে পারেনি।

যার প্রতিক্রিয়া আমরা সাম্প্রতিক সেই শিক্ষকের বক্তব্যের পরে দেখতে পাচ্ছি। এই সমালোচনা বা প্রতিক্রিয়াকে মোকাবেলা করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে, নতুবা এই অবস্থার কোন পরিবর্তন যেমন আসবে না তেমনি ভবিষ্যতেও যারা পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাইবে তারাও মনোবল হারিয়ে ফেলবে। 

শরীফার গল্প সমাজে সেই মানবিক পরিবর্তন নিয়ে আসার প্রথম পদক্ষেপ। সেখানে শরিফার মাধ্যমে সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। শরিফার যে শারীরিক বৈশিষ্ট্য তার জন্য তাকে পরিবার বকাঝকা করে, নানা কারণে প্রহার করা হয়, আবার পাড়া-পড়শিরা তার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করে। স্কুলের সবাই ভীষণ অবহেলা করে যার কারণে সে খুব কষ্ট পায় এবং নিজেকে একা মনে করে।

অবশেষে বাধ্য হয়ে দূরে গিয়ে থাকতে শুরু করে শরীফা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আঁখি ও রেখা দুজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি মানুষের কাছে টাকা চেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। পরিবার সমাজ থেকে তাদের লুকিয়ে রাখার জন্য ঘরে আটকিয়ে রাখতো যেন কেউ কটু কথা না বলে এই ভয়ে। এক রাতে তারা বাড়ি থেকে চলে আসতে বাধ্য হয় পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে। তাদেরও ইচ্ছে করে বাবা, মা, ভাই-বোনের সাথে থাকতে।

যদি পরিবারের লোকজনকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে তাহলে রাতের আধারে বাড়ি গিয়ে দেখা করে আবার রাতেই বাড়ি থেকে তাকে চলে আসতে হয়। এই আঁখি ও রেখাই হলো পাঠ্যপুস্তকের শরিফার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সমাজে এমন হাজারো শরিফা রয়েছে যারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করছে। অথচ স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা করা, চাকরি-ব্যবসা করার ইচ্ছা ও অধিকার তাদেরও রয়েছে। এই বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফার গল্প-র মাধ্যমে।

এই গল্পে সমকামিতা ও ধর্ষণ বৃদ্ধির আলামত কোথায় সেটা বোধগম্য নয়। এটা একটি অপব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই নয়। সমাজে প্রথাগত চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন করতে গেলে এমন অপব্যাখ্যা, বিরোধী শক্তির বাধা আসবে, সেটাই যুগে যুগে হয়ে আসছে। আমরা যদি অতীতে তাকাই তাহলে দেখা যাবে ব্রিটিশরা যখন এদেশীয় সৈন্যদের সমুদ্র পাড়ি  দিতে বলেছিল তখন কালা পানি পাড়ি দেওয়া পাপ বলে সেটা করতে প্রথমে অস্বীকার করেছিল, আবার ১৮৩৯ সালে সতীদাহ প্রথা রহিত করতে রাজা রামমোহন রায় এবং ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এক শ্রেণির বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

ইতিহাসে এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে যারা কোন পরিবর্তন মানতে নারাজ। এই মানতে না পারার পেছনে রয়েছে তাদের গোষ্ঠী স্বার্থ, এই স্বার্থ যত ভারি বিরোধিতা তত জোরালো। সুতরাং মানবিক সমাজ গড়তে হলে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে এই বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হবে, অন্যথায়  সোনালী ভোরের দেখা অধরাই থেকে যাবে।

বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বে জায়গা করে নিচ্ছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে যে মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে বা সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো চলমান রাখার জন্য টেকসই উন্নয়ন প্রয়োজন। এই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে। তার জন্য মানবিক পরিবর্তন বা মানবিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মেগা প্রকল্প প্রয়োজন।

এই প্রকল্প হাতে না নিলে শরিফার গল্প যেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে আবার পদ্মা সেতু, থার্ড টার্মিনাল ও কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনের মত দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার সৌন্দর্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ সকল মানুষের জন্য উপযোগী ও অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নে আমরা যে সমাজ চাই সেই সমাজে শরিফারা কোন অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও বৈষম্যর শিকার না হোক। সকল উন্নয়নে তাদেরও অংশীদারিত্ব থাকুক। এর পূর্বে প্রয়োজন আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, ‘শরীফার গল্প’সেই পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

লেখক: প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।