নিজস্ব প্রতিবেদক

সাত বছর পার হলেও বিএনপির সপ্তম জাতীয় সম্মেলন হয়নি। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় দলের ভিতরে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অর্ধশতাধিক কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। অধিকাংশ জেলায় আংশিক আহ্বায়ক কমিটি হলেও দীর্ঘদিনেও সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। প্রবল হয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং। একারণে সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপির কর্মীরা রাজপথে নামেনি।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন করেছিল বিএনপি। গঠনতান্ত্রিকভাবে তিন বছর পরপর এই সম্মেলন হওয়ার কথা। তবে সাত বছর পার হলেও সপ্তম জাতীয় সম্মেলন হয়নি। সাত বছরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হয়েছে মাত্র একবার। ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই সভার পর কেটে গেছে পাঁচ বছর। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য আছে পাঁচটি। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যানের ১৩টি, উপদেষ্টা ১৫টি, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকসহ প্রায় একশর মতো পদ শূন্য হয়ে আছে।

আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল শক্তি দুটি সহযোগী ও ৯টি অঙ্গসংগঠন। তবে এগুলোর সাংগঠনিক অবস্থাও বেহাল। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল গঠনতান্ত্রিকভাবে বিএনপির সহযোগী সংগঠন। আর অঙ্গসংগঠন হিসেবে রয়েছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, ওলামা দল, জাসাস ও মহিলা দল। এসব সংগঠনের মধ্যে কয়েকটির পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকলেও বেশিরভাগের মেয়াদ নেই। সবচেয়ে করুণ দশা শ্রমিক দল, ছাত্রদল, মহিলা দল ও জাসাসের।

জেলা-উপজেলা কমিটিরও একই অবস্থা। এতে স্থবির হয়ে আছে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অর্ধশতাধিক কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। অধিকাংশ জেলায় আংশিক আহ্বায়ক কমিটি হলেও দীর্ঘদিনেও সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কমিটি গঠনে স্থানীয় প্রভাবশালীদের তৎপরতা কিংবা কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের কারণে প্রবল হয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুরোদমে দল পুনর্গঠন কাজ শুরু করেছিল বিএনপি। সেই সময় মূল দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি হালনাগাদের উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। ওই উদ্যোগের পর মাত্র ২০টির মতো জেলা কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

জেলা ও উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানান, তৃণমূল পর্যায়ে অধিকাংশ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। মাঝেমধ্যে কমিটি করতে গেলে বিশেষ ‘সিন্ডিকেট’ তাতে হস্তক্ষেপ করায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময়েও জেলা শাখা ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মী দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। অনেকে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘এটা সত্য যে, দলের অনেক সাংগঠনিক জেলা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে। সেগুলো ঢেলে সাজানোর কাজ অচিরেই শুরু হবে।’ সম্মেলনের বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতির দুটি প্রধান বলয়। একটি আওয়ামী লীগ আরেকটি বিএনপি। ভুল-ত্রুটি সংশোধন করেই বিএনপিকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’

 রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাস সিংহ রায় বলেন, বিএনপির কার্যক্রম এতটাই বিতর্কিত যে তারা জনসম্মুখে তাদের অবদান তুলে ধরতে ভয় পায়। বিএনপি দুবার দেশ শাসন করে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে। তাদের কারণে বাংলাদেশ দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। উন্নয়নের বদলে দেশকে পিছিয়ে দেয়াই ছিল তাদের অর্জন। ভোট বর্জন করে বিএনপি নিজের দলের নেতাকর্মীদের কথাও উপলব্ধি করেনি, ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখতে পারছেনা নেতাকর্মীরা। তাই বার বার আন্দোলন ডাকলেও তাতে নিজ দলেরই সাড়া মিলছে না।’