মেহেদী উল্লাহ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে ২২২টি আসনে, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১ আসনে এবং জাসদ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি করে আসনে জয়ী হয়েছে। এছাড়া ৬২টি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নির্বাচনে ৭টি ইসলামী দলের মোট প্রার্থী ২৭৬ জন অংশ নিলেও একজন প্রার্থীও জয়লাভ করতে পারেননি। এমনকি দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও আসতে পারেননি। বিজয়ী হতে না পারলেও নির্বাচন নিয়ে কোনো কোনো ইসলামী দলের আগ্রহ ও ভাবনা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার উদ্রেক করছে।
রাজনীতিতে সবসময় জয়ী হওয়াই বড় কথা নয়, কখনো কখনো পরাজয়ও বড় অর্থ বহন করে। সে হিসেবে ইসলামী দলগুলো নতুন বার্তা দিচ্ছে কি? একথা সত্য, নানা বাস্তবতায় বাংলাদেশে কখনোই ইসলামী দলগুলোর সামর্থ ঘটবে না। যে কারণে বা জোটগতভাবেও ইসলামী দলের সরকার গঠনের সম্ভাবনা কম। তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বাস্তবতায় রক্ষণশীল ইসলামপন্থী দলগুলোর একত্রে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। এর বড় কারণ হচ্ছে, দেশে বিরোধী দলের শূন্যতা।
ভবিষ্যতে বিএনপির মতো দলের সময় উপযোগী ও বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে পারার অক্ষমতাজনিত কারণে অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিএনপির সবচেয়ে বড় সংকট বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি। বর্তমানে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক কৌশল ও বুদ্ধিবৃত্তিক পারদর্শিতা, সে তুলনায় বিএনপি হাজারগুণ পিছিয়ে। বর্তমানে দলটির যে হাল ও সাংগঠনিক ভঙ্গুর দশা তাতে জনগণ মাত্রই অবগত।
বিএনপি নির্বাচনের আগে আন্দোলনে বলেছিল, বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের নেতৃত্ব সাজানো। একজনের অনুপস্থিতিতে পরেরজন নেতৃত্ব গ্রহণ করে কার্যক্রম এগিয়ে নিবে। তাদের এসব বক্তব্য ফাঁকাবুলি ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। এখন বোঝা যায় তারা অপেক্ষায় ছিল, আমেরিকা বুঝি এই ক্ষমতায় বসিয়ে দেয় ওই তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। এতেই বোঝা যায় বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলে বুদ্ধিবৃত্তিক অমাবশ্যা চলছে। সার্বিক বিচারে, দলটির কৃষ্ণপক্ষে বুদ্ধিজীবিতার শুক্লপক্ষের কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না আপাতত।
এখন বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে দলটি নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রধান বিরোধী দল হিসেবেও থাকে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ। বিএনপি যেহেতু রাজনৈতিক কৌশলে পিছিয়ে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এগিয়ে, ফলে এই এগিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে তো কোনো ক্ষতি নেই আমেরিকা বা ইউরোপের।
একন আমেরিকার মাথাব্যথা হতে পারে রক্ষণশীল ইসলামপন্থী দলগুলোর উত্থান নিয়ে। ফলে বিএনপির উত্থানের চেয়ে রক্ষণশীল ইসলামপন্থী দলের দমন তাদের নীতির সাথে যায়। আরেকটি বিষয়ও তারা কৌশলগত কারণে আশা করে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলাম সংক্রান্ত সমস্যা জিইয়ে রাখা। সেদিক থেকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলো প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকা নিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এদেশে বিএনপি যারা করে তাদের কাছেই নিজের দলটি বোঝায় পরিণত হয়েছে। দলটির কার্যকর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে সমর্থকরা হতাশই হচ্ছেন। অন্যদিকে ভবিষ্যতে রক্ষণশীল ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধ হলেও সেখানে জামায়াত ইসলামীকে সঙ্গে রাখার কোনো সম্ভাবনা নেই।
জামায়াত যতখানি না দল, তার চেয়ে এটি একটি গোষ্ঠী। চিহ্নিত গোষ্ঠী বললে ভুল হবে না। তাদের রাজনীতি যারা করে তাদের মধ্যে গোষ্ঠীগত চেতনা কাজ করে। এদেশে অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মী, সমর্থকরা জীবনকে রাজনীতি দিয়ে যতখানি না ভাবেন, তার চেয়ে বেশি ভাবেন একটি আদর্শ দিয়ে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী যারা করে তারা জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে দলীয় কার্যক্রমকে ফুটিয়ে তোলে বলেই মনে হয়। তাই গোষ্ঠীগত চেতনার বাইরে সাধারণ মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন কোনো কালেই তারা বাংলাদেশে পাবে না।
জামায়াত দিনশেষে একটি ধর্মীয় এনজিও কিংবা বলা যায়, কো অপারেটিভ সোসাইটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দলটির যে ভূমিকা তাতে এদেশে রাজনীতি করারই অধিকার পাওয়ার কথা ছিল না। তবুও কেউ কেউ তাদের ব্যবহার করার জন্য টিকিয়ে রেখেছে। এটি আর কেউ না বুঝলেও দলটি ভালো বোঝে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গোষ্ঠীটি এদেশে ব্যবসা করে যাচ্ছে নানাভাবে। বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে যারা আকাশে অন্যদেশের চাঁদ-তারা দেখে তাদের ভবিষ্যতে রাজনীতি করাটা মোটেও সহজ হবে না।
নিবন্ধিত ইসলামী দলগুলোর মধ্যে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক চারটি দল এবার নির্বাচনে যায়নি। সেই দলগুলো হলো: ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২৯৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিলো। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও তারা ভালো ভোট পেয়ে দৃষ্টি কাড়ে। ফলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে দলটির আশা আছে!
সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সামাজিকীকরণে ও সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব বেড়েছে। ধর্মীয় দলগুলো এই সামাজিকীকরণকে রাজনীতিকরণ করতে পারলে ভবিষ্যতে তারা বিরোধীদলের ভূমিকায় চলে যেতে পারে। সেই সময় কার্যত দেশে আওয়ামী লীগ ও এর বিপরীতে রক্ষণশীল ইসলামপন্থী দলগুলোও ক্রিয়াশীল থাকবে।
জাতীয় পার্টি (জাপা) যেভাবে বর্তমানে আছে, দলটির ভবিষ্যতও ভালো না। বাংলাদেশে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত ইসলামী দল সব মিলিয়ে ৭০টিরও বেশি। এর মধ্যে নিবন্ধিত আছে ১১টি । দলগুলোর কোনো কোনোটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভাবনা তাদের বক্তব্যে প্রকট হয়ে ওঠে কখনো কখনো। ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলছিলেন, ‘আমাদের অবস্থান স্বতন্ত্র। আমরা বিএনপির সঙ্গেও নেই, আওয়ামী লীগের সঙ্গেও নেই।’ এই বক্তব্য প্রমাণ করে দলটি নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে ভাবছে। এভাবে অন্য দলগুলোও ভাবতে শুরু করবে অচিরেই। ফলে ইসলামের স্বার্থে এক ছায়ায় মিলিত হতে পারে দলগুলো। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বাস্তবতার বাইনারি তাই আওয়ামী লীগ বনাম রক্ষণশীল ইসলামপন্থী দলগুলো। সেখানে এনপি-জামায়াত কিংবা জাপার মতো দলগুলো তৃতীয়-চতুর্থ স্থানে চলে যাবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগকে রক্ষণশীল ইসলামপন্থী দলগুলোর মুখোমুখী হতে হবে। সেকালে ইসলামী দলগুলোকে নানাভাবে ব্যবহার করতে চাইবে বিভিন্ন পরাশক্তি। সেসময় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল কী হবে তার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।