নিজামুল হক বিপুল

বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে এখন ক্রান্তিকাল যাচ্ছে। বিশেষ করে নিজেদেরকে দেশের প্রধান রাজৈনৈতিক দল বলে দাবি করা বিএনপি দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ধরে রাজপথে আছে। কিন্তু মাঠের রাজনীতিতে তাদের  কর্মকাণ্ড একেবারেই জনবান্ধবহীন। এখন পর্যন্ত বিএনপি যেসব ইস্যু নিয়ে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে তার সবগুলোই ছিল ব্যক্তি কেন্দ্রিক ইস্যু। অর্থাৎ খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমান ইস্যুতে। অথচ তাদের দুই জনই আইনি প্রক্রিয়ায় দণ্ডিত ব্যক্তি। এর বাইরে বিএনপি আরও একটি ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছে, আর সেটি হলো মৃত তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তনের দাবিতে। অথচ এই ব্যবস্থাটির মৃত্যু ঘটেছে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেই। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার এই মৃত্যর জন্য বিএনপিই পুরোপুরি দায়ি। এ কথায় জনবাবন্ধব ইস্যুতে বিএনপি বরাবরই নিখোঁজ!

অবশ্য আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দৈন্যতার চিত্রই তুলে ধরে। এটি কোনো সমস্যার সমাধান না। এটি বরং এক দলকে বাদ দিয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় পৌঁছানোর একাট সিঁড়ি। তাতে দেশের বা দেশের জনগণের তেমন কোনো ফায়দা নেই। বরং ফায়দা হচ্ছে যারা মাস তিন একের জন্য দায়িত্ব পালন করেন এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এই পরিচয় দিয়ে অধ্যায় শেষ করেন। আর রাজনৈতিক দলগুলোর ফায়দা হচ্ছে তারা ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর সুযোগ পায়। 

একটা রাষ্ট্র বা দেশ চলে সংবিধানের উপর ভিত্তি করে। সঙ্গত কারণেই সংবিধানের আলোকেই সবকিছু হওয়া বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে অনেক সংকট হয়তো দ্রুত সমাধান করা যায় না। তবে ধীরে ধরে সংকট দূর করার পথে হাঁটতে হয়। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা এবং সুসম্পর্ক থাকাটা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই সম্পর্কটা বেশ শীতল। দূরত্ব যোজন যোজন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আদর্শিক দূরত্ব।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসার যে ‘বিষ’ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি আজও বহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে কথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে যে নোংরা আবর্জনা ঢুকিয়েছিলেন, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে যাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেই ধর্মীয় মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি, একাত্তরের পরাজিত রাজাকার, আলবদর, আল শামস, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত, মুসলিম লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করে এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত করে জিয়াউর রহমান মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। প্রতিহিংসাকে উস্কে দিয়েছেন।

তারই ধারবাহিকতায় ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসে বিএনপি একইভাবে এসব গোষ্ঠিকে সবধরণের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। যা দেশের সিংহভাগ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি।

২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে প্রগতিশীল রাজনীতিতে শেষ পেরেকটা মারে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাদিকে মন্ত্রী বানিয়ে গাড়ি-বাড়িতে পতাকা তুলে দিয়ে খালেদা জিয়া কার্যত জিয়াউর রহমানের ধারবাহিকতা রক্ষা করে রাজনীতিকে কলংকিত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের শহীদদেরকে অবমাননা করেছিলেন। আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সস্ত্রাস বিরোধী শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে এদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিমূর্ল করার যে নীল নকশা করেছিলেন তারেক রহমান তাতে করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কবর রচনা করা হয়।

এই ঘটনার পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নির্ধারিত সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং নিজেদের দলীয় রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে। আর তখনই কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কবর রচনা হয়।

মূল আলোচনায় আসা যাক। বলছিলাম, বিএনপি গত ১৭ বছর ধরে আন্দোলন করছে। কিন্তু তাদের আন্দোলনের একটা ইস্যুও জনবান্ধব নয়। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বহু ইস্যু সামনে এসেছিল। দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ এর দাম বৃদ্ধি, জ্বালানী তেল ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা, শেয়ার মার্কেট, সড়ক দুর্ঘটনার মত বড় ইস্যুসহ জনস্বার্থ বিষয়ক আরও অনেক ইস্যু এসেছিল। কিন্তু বিএনপি এসব ইস্যুর একটি নিয়েও কখনো আন্দোলন করেনি। তারা তাদের নিজেদের ইস্যুর বাইরে যেতে চায়নি বা যায়নি।

যেসব ইস্যুতে আন্দোলন করে সরকারকে চাপে ফেলা যায়, মানুষের মন জয় করা যায়, তেমন কোনো ইস্যুতেই রাজপথ গরম করা তো দূরের কথা বিএনপিকে কোনো কথা বলতে দেখিনি। অথচ গণতান্ত্রিক দেশের বিরোধী দলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিরোধী দলই মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে পারে জনস্বার্থ ইস্যুতে সরকারকে চাপে রেখে।

দেশে ৯৫ ভাগ লোক এখন বিএনপির পক্ষে দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের লড়াই জনগণের ভোটের অধিকার, জনগণের কল্যাণ ও গণতন্ত্রের মুক্তি। কাজেই আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এই মুহূর্তে লড়াই করছি না। আশা করি, আমাদের চলমান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকারকে ফেলে দিতে পারব।’

তার এই বক্তব্য শুনে শুধুই হাসি পেয়েছে। গত ১৭ বছর ধরে তারা এই একই কথা বলে আসছেন। জনগণের ভোটের অধিকার আর গণতন্ত্রের মুক্তির কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। কিন্তু যে জনগণের ভোটের অধিকারের কথা বলছেন, সেই জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা যেমন কোনো আওয়াজ তুলতে পারেননি, তেমনি জনগণকেও তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারেননি।

একটা বিষয় খুবই পরিস্কার। সাধারণ মানুষ এখন আর তাদের কথায় বিশ্বাস করেন না। এর কারণ ১৭ বছরে তারা কোন জনসম্পৃক্ত বিষয়ে আন্দোলন করেননি। তাই জনগণও সম্পৃক্ত হননি। তারা আন্দোলন করেছেন শুধুই নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া জন্য। কারণ শুদু মাত্র ভোটের অধিকারই জনগণের অধিকার না। বরং জনগণের অধিকার হচ্ছে- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা। এসব ইস্যুতে বিএনপির মত রাজনৈতিক দলকে মানুষ পায়নি। তাই বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সাধারণ মানুষ তার জীবন বাজি রাখতে নারাজ। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক:  সাংবাদিক ও কলামিস্ট।