পলাশ আহসান
আমাদের ছাত্র জীবনে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর যখন লেখাপড়ার বিষয় আলাদা হয়ে গেলো, আমার আজকের লেখার গল্পটা ওই সময়ের। আমরা একেকজন তখন একেক বিষয়ে পড়ি, কিন্তু সরল আড্ডায় যুক্ত হই সবাই। সেখানে একেকজনের পড়ার বিষয় নিয়ে গল্প বানানোর একটা চল ছিল। নির্মল মজার সব গল্প। পরিসংখ্যানের বন্ধুদের নিয়ে গল্পটা ছিল এরকম। শুকনো মৌসুমে নদীর ধারে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। তাঁকে এসে আরেক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন ‘ভাই নদীতে পানি কতটুকু’? যাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি পরিসংখ্যানের ছাত্র। তিনি জবাব দিলেন ‘পানি গড়ে এক ফুট’। ভদ্রলোক নিশ্চিন্তে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নদীতে নেমে গেলেন। কিছু দূর গেলেনও। হঠাৎ নেমে গেলেন গলা পনিতে। গলা পানিতে দাঁড়িয়ে ওই ভদ্রলোক পরিসংখ্যানের বন্ধুকে বললেন, ভাই আপনি বললেন পানি একফুট! এটা কী হলো? পরিসংখ্যানের বন্ধু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আপনি খেয়াল করেননি, আমি বলেছিলাম পানি গড়ে একফুট। আপনি এখন তথ্যের সর্বোচ্চ সীমায় আছেন”।
আমাদের এবারের নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এই গল্পটা খুব মনে পড়ছিল। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে যখন নানা সংগঠন একপেশে মন্তব্য করছে, কিন্তু সার্বিক তথ্য দিচ্ছে না। ঠিকঠাক গড় কেউ করছে না। কেউ গড়ের মত করে বললেও, নিজের পছন্দ নয় এমন তথ্য বাদ দিয়ে গড় করছেন। যার যেখানে সুবিধা সেখান থেকে তথ্য দেয়া শুরু করছেন। ঠিকঠাক শুনে, বুঝে না চললে তো গলা পনিতে নামতেই হবে। নির্বাচন নিয়ে সবশেষ ওই রকম সিদ্ধান্ত দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংলাদেশে। একটি গবেষণা ও গবেষণা পদ্ধতির ওপর ভর করে তারা বলেছে, নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি। পরে তারা নানা নির্বাচনী অনিয়মের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রায় এই একই সুরে নির্বাচনের সামালোচনা করেছে নির্বাচনে অংশ না নেয়া রাজনৈতিক দল বিএনপি। তাদের সুরে ও লয়ে কথা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিএনপির নিয়ে সমালোচনা নিয়ে আমার কোন কথা নেই। তারা একটি রাজনৈতিক দল। তারা একটি দর্শন প্রতিষ্ঠা করার রাজনীতি করে। ভিন্ন মতের কাজে তারা সমালোচনা করবে, এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলের ভুল ক্রুটি জনগণ বিবেচনায় নেবে। মার্কিন সামালোচনাও আমার খুব অস্বাভাবিক মনে হয় না। আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে নিয়ে যে বলয়ে ছিলো আজও সেই বলয়ে আছে। বিশেষ কোন দলতো তাদের কাছে ফ্যাক্টর নয়। তাদের ফ্যাক্টর বলয়। সেটা আজকের আলোচনার বিষয় নয়। আজকের আলোচনা, সম্প্রতি শেষ হওয়া খুবই সরল একটি নির্বাচন নিয়ে।
আমরা যদি টিআইবির রিপোর্টটি দেখি, সেখানে কোথাও বলা হয়নি যে নির্বাচন হয়েছে টানা দুইদিন হরতালের মধ্যে। নির্বাচনের ঠিক একদিন আগে ঢাকায় একটি ট্রেনে আগুন দিয়ে চারজন মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন যায়গায় বোমা ফাটিয়ে ভোট কেন্দ্রে আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। পরিকল্পিত গুজবে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল পুরো নির্বাচনী পরিবেশ। টিআইবির রিপোর্টে ৫০টি আসন থেকে তথ্য সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। তাদের কথা যদি সত্য ধরি তাহলেও কি ৫০টি আসনের তথ্য দিয়ে ৩০০ আসনের সার্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো নৈতিক? মানুষের ভোট দেয়ার প্রবণতা একেক জায়গায় একেক রকম। গড় তথ্য দিয়ে মানুষের মনো বিশ্লেষণ কতটুকু ঠিক তা নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে প্রশ্ন রয়েছে।
আমরা ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে যদি একটা সরল হিসাবে যাই, দেখবো সেখানে গড়ে ভোট পড়েছে ৮৭ ভাগ। এটাই আমাদের দেশের সর্বোচ্চ ভোটের হার। সেই নির্বাচনে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ ভোট পায় ৪৮ ভাগ এবং জাতীয় পার্টি ৭ ভাগ। বিএনপি পায় ৩২ ভাগ। নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনে আছে বিএনপি। তাদের বেশিরভাগ ভোটার ভোট দিতে যাবে না সেটাই স্বাভাবিক। বাকি ৫৫ ভাগের মধ্যে ১৫ ভাগও যদি ভয় পেয়ে ভোট দিতে না যায় সেটা কী খুব অস্বাভাবিক হবে? এরমধ্যে শতকারা ৪২জন ভোটার ভোট দিতে বের হতে পেরেছে। আমাদের বলা উচিত ভোটারদের দিক দিয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলকই হয়েছে।
এই ৪২ ভাগ ভোট পড়ায়ও খুশি হয়নি টিআইবি। তাদের মনোভাব বলছে, ভোট আরও কম পড়ার কথা। ভোটারদের জোর করে কেন্দ্রে আনা হয়েছে। ভোটারদের জোর করে কেন্দ্রের আনার তথ্য সেইভাবে গণমাধ্যমেও আসেনি। গণমাধ্যমে এসেছে, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আপনারা নির্ভয়ে ভোট দিতে যান। একজন নির্বাচন পরিচালক যদি বলেন ‘আপনারা ভোট দিতে যান’ দোষ কোথায়? বিএনপির পক্ষ নিয়ে ইসিতো বলতে পারে না যে ‘আপনারা ভোট দেবেন না’ এর আগেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেয়ার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ বলছে, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি দুদলই নির্বাচনে ফল খারাপ করেছে। তাদের সব ভোটার ভোট দিতে আসেনি। এমনকী ২০০৮ সালের নার্বাচনী ফলাফলের চেয়ে তারা দুদলই আসন কম পেয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ। টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাপ্রাপ্তদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্যে হুমকি দেয়া হয়েছে। প্রচলিত গণমাধ্যমে এমন রিপোর্টও দেখিনি। আমার জানামতে সরকারি সুবিধাপাপ্রাপ্ত ভোটারের সংখ্যা পাঁচকোটি। এই পাঁচকোটি ভোটার কী হরতালের বাধায় ভোট কেন্দ্রে আসতে পেরেছে? এই সুবিধাভোগীরা সবাই ভোট দিতে পারলে তো ভোটের হার ৫৫ থেকে ৬০ হয়ে যাওয়ার কথা।
তবে টিআইবির একটা বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের দিক দিয়ে সবদল নির্বাচনে আসেনি। যে কারণে দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। আমিও বলতে চাই এবারের নির্বাচন ২০০৮ এর মত হয়নি। কিন্তু নিজেকে অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাবি করে যদি বলতাম, তাহলে বলতাম কেন এবারের নির্বাচন ২০০৮ এর মত হয়নি। যে দাবিতে বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে, সেই দাবিটি কতটা যৌক্তিক সেই বিশ্লেষণটাও করতাম। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম একটা লেখায় এরকম একটি বিশ্লেষণ করেছিলেন। অসাধারণ সেই বিশ্লেষণে তিনি বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এসে নিজেদের নৈতিকতার সূচক কতটা নামালো।
রিপোর্ট প্রকাশের পর টিআইবির প্রধান একটি জাতীয় দৈনিকের সাক্ষাতকারে বলেছেন আজকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও বলতো টিআইবি আওয়ামীপন্থী। আসলে তিনি কোন পক্ষ না। তিনি নিরপেক্ষ। আসলে এই নিরপেক্ষ চরিত্র কারো চাওয়া নয়। নিরপেক্ষ থাকতে গিয়ে, তিনি যদি ৪২ হাজার ভোট কেন্দ্রের ভোট মূল্যায়ন করেন গুটিকয় কেন্দ্রের ওপর ভর করে, নির্বাচনী কৌশলকে যদি তিনি ‘খেলা’ হিসাবে মূল্যায়ন করেন তাহলে কী তিনি নিরপেক্ষ থাকলেন? একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে তিনি যদি নির্বাচন মূল্যায়ন করে থাকেন আমার কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু তিনি যদি নিরপেক্ষতার দাবি তোলেন, তাহলে অবশ্যই তাঁকে নিউটনের সূত্র মানতে হবে। ‘প্রত্যেকটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে’ আজ যদি আমি বলতে চাই ২০২৪ এর নির্বাচন ২০০৮ এর নির্বাচনের মত হয়নি। তাহলে কেন হয়নি কোন পক্ষের বাধায় হয়নি, কোন অনমনীয় মনোভাবের কারণে হয়নি, সবই বলতে হবে। সব না শুনে না বুঝে যারা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা ওই পরিসংখ্যানের গল্প শোনা লোকটির মত গলা পানিতে নেমে যাবেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।