পলাশ আহসান

নতুন মন্ত্রিসভা কাজ শুরু করার পর আমার কেন জানি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথা বার্তা অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা লাগছে। একটি টিভি টকশোতে দেখলাম বলছেন, অনেক কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। নতুন শব্দটি বার বার আসছে। সব শেষ এই মঙ্গলবারেই বলতে শুনলাম যেসব হাসপাতাল ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নেই তাদের বলছেন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে। তিনি এখনও সরাসরি কিছু বলেননি । হয়তো বলবেনও না।  কিন্তু বার বার ‘ভাবতে হবে’ ‘নতুন করে করতে হবে’ এজাতীয় টার্ম ব্যববহার করছেন। আমি বলবো বলতে বাধ্য হচ্ছেন। অথবা কাজের কথা বলতে গিয়ে তাকে বলে ফেলতে হচ্ছে। 

এরই মধ্যে এক অনুষ্ঠানে ৫ শয্যার বার্ন ইউনিট ৫শ শয্যায় উন্নীত করতে গিয়ে তাঁর নিজের বঞ্চনার কথা বলে ফেলেছেন। বলেছেন তাঁর ফাইল ছুঁড়ে ফেলার কথা । একজন ডা. সামন্ত লাল সেন যখন বার্ন ইউনিটের কাজ করছিলেন তখন তিনি নিশ্চয়ই বয়স ষাট পার করেছেন। কাজ করে নিশ্চয়ই তাঁর সমাজে একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করেছেন। এরকম একজন মানুষের এমন ‘অসম্মান’ দিয়েই আমাদের স্বাস্থ্য  খাতে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা তা মাপা যায়। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী যতটাই ঢেকে ঢেকে বলার চেষ্টা করুণ না কেন, সত্যি সত্যিই আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়মে নেই।

একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে আমি বলতে পারি, হাজার চেষ্টা করেও এই খাত জনবান্ধব করা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় বোঝা যাচ্ছে এই সরল সত্যটি তিনিও বোঝেন। যে কারণে তিনি বার বার বলছেন, চেষ্টা করলে হবে না কেন? তিনি নিজে দীর্ঘদিন এই খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। যে কারণে তিনি বুঝেই এসছেন যে, এখানে তার চেষ্টা করার জায়গা অনেক। তাই বার বার তিনি কাজ করার জন্যে সবার সহায়তা চাইছেন। গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে আমি তাঁকে বলতে পারি, প্রতিদিন সেই দূর গ্রাম থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত, সারাদেশ থেকে স্বাস্থ্য খাতের শত শত তথ্য আমাদের কাছে আসে। এখান থেকে স্বাস্থ্যখাত নবায়নের চেষ্টার তালিকায় নতুন উপাদান যুক্ত হতে পারে।  

স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো নিয়ে সবচেয়ে বেশি খবর আসে আমাদের কাছে। হাসপাতালে বেড নেই, ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, আরও হাসপাতাল দরকার , অবহেলায় মৃত্যু, এজাতীয় খবরই আমাদের কাছে প্রতিদিন বেশি আসে। কিন্তু যে খবর কম আসে সেটা হচ্ছে অন্তর্গত অনিয়ম। যে অনিয়ম না থাকলে বেশি আসা খবরগুলো কমে যেতো। সামন্ত লালের কথায় যে সুর কিছুটা হলেও পাওয়া যায়।

প্রথমে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় আসি। নিজে ভুক্তভোগী না হলে এই অনয়িমগুলো বোঝা যায় না। ধরা যাক কোন রোগীর জেলা সদরে হাসপাতালে ভর্তির দরকার হলো। তিনি যদি কেবিন পেতে চান, তাকে তদাবির করতে হবে। যার কথা বলার লোক নেই তার ভাগ্য ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেয়া। এমনকি ওয়ার্ডেও তিনি শয্যা না পেতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে মেঝেতেও চিকিৎসা নিতে হতে পারে। এই চিত্র সেই উপজেলা থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত। উপজেলা শহর থেকে ঢাকার দিকে যত এগোনো যাবে এই তদবিরের প্রভাব তত বেশি। ঢাকায় এসে এই প্রভাবের নাম ভয়ঙ্কর। আর সেটা যদি কোন বিশেষায়িত হাসপাতাল হয়, তাহলে সেটা যে কী, তা বোঝাতে নতুন বাংলা শব্দ লাগবে। 

আসলেই সবার আগে দরকার তববির মুক্ত সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা। কারণ এই তদবিরের মধ্যে বেশিরভাগ সময় বিনিময় থকে। জেলা শহরের দিকে  থাকে টিপস পর্যায়ে । বিভাগীয় শহর থেকে পরিণত হয় বাণিজ্যে। ঢাকায় এসে হয়ে যায় বাণিজ্য সিন্ডিকেট। প্রতিটি হাসপাতাল কেন্দ্রিক এসব সিন্ডিকেট হাসপাতালের খাবার থেকে শুরু করে শয্যা, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স সবই নিয়ন্ত্রণ করে। এরাই বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের এজেন্ট হয়ে কাজ করে। রোগীর স্বজনদের ফুসলে বেসরকারি চিকিৎসার কাছে নিয়ে যায়। কোন কোন যায়গায় এরা এত শক্তিশালী হয় যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলে “তারা জিম্মি”। কিন্তু কেন জিম্মি? একদল চোরের চক্রটিকে কেন রাষ্ট্র শক্তি ভাঙতে পারে না ? সেই প্রশ্নের কোন যৌক্তিক উত্তর আমি খুঁজে পাইনি। আমি বিশ্বাস করতে চাই আমাদের নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেই উত্তর পাবেন এবং দুষ্টুচক্র মুক্ত করবেন আমাদের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা। 

আসছি বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে। গত ১০ বছর ধরে ঢাকার বাইরে যেকোন শহরে গেলে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার। মনে হয় এরচেয়ে সহজ  ব্যবসা আর নেই। এই চিকিৎসা ব্যবস্থার অনিয়ম নিয়েও হাজারও তথ্য আমাদের হাতে আসে। একটু আগে সরকারি হাপাতালের যে চক্রের কথা বলছিলাম, সেই চক্রের সঙ্গে এদের যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি।  রয়েছে রোগী পাঠানোর কমিশন বাণিজ্য। তবে মানুষ বান্ধব দু’একটি বেসরকারি হাসপাতাল যে নেই তা বলা যাবে না। কিন্তু সেই হার একেবারেই হাতে গোনা। একই চিত্র বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও। এদের প্রত্যেকের মেডিক্যাল পরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠানোর কমিশন বাণিজ্যের সঙ্গে একশ্রেণির ডাক্তারও জড়িত।

আরেকটি চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা আলাদা করে না বললেই নয়। সেটা হচ্ছে আমাদের ফাইভ স্টার মানের যে চিকিৎসা। জ্বরের চিকিৎসাও যেখানে লাখের ধাক্কা। সাধারণত আমজনতা তাদের রোগী নয়। কিন্তু জিনিসটার নাম যখন চিকিৎসা তখন কোন কারণে যেকোন মানুষকে সেখানে যেতে হতেই পারে। সমস্যা হচ্ছে, যাওয়ার আগে কারো কারো মনে পড়ে না যে, বের হওয়ার সময় সর্বশান্ত হতে হবে। কারণ সেসময়তো থাকে প্রাণে বাঁচার আকুতি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কে তাদের সেবার দাম নির্ধারণ করে? আমি নিশ্চিত আর যেই হোক সেই তালিকায় জনগণের প্রতিনিধি থাকে না। যারা থাকে, আমার দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের কথা তাদের মাথায় থাকে না। থাকলে এই সেবার দাম এরকম অসভ্য পর্যায়ে যেতে পারে না। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, একটি স্বাধীন দেশে এই স্বেচ্ছাচার অপরাধ। 

কোভিড মোকাবেলার অভাবনীয় সাফল্যের কথা বলে লেখাটির শেষ করতে চাই। স্বাস্থ্যখাতের হাজারো অনিয়মের কথা বলার পর এরকম একটা সাফল্যের কথা খানিকটা বেখাপ্পা লাগতে পারে। কিন্তু আমি আসলে এই সাফল্য উদাহরণ হিসাবে দেখতে চাই। কোভিড কেতাবি দিক দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের অংশ হলেও এটি মোবাবিলায় নেমেছিল গোটা দেশ। কাজে ছিল সেনাবাহিনীসহ দেশের প্রতিটি সরকারি বেসরকারি দপ্তর । তদারক করছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।  ফলে এর সাফল্য চোখে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বার বার বলছেন, সাফল্যের জন্যে সমন্বিত কার্যক্রম দরকার। কোভিডের সাফল্যও সমন্বিত কার্যক্রমের ফল। কিন্তু একথাও মাথায় রাখা দরকার, কোভিডের কড়াকড়ির মধ্যেও স্বাস্থ্যের শরীরে ঢুকে পড়েছিল শাহেদের মত কয়েকটি বিষাক্ত জীবানু । খানিকটা আক্রান্তও করেছিল। ওই সময় সেটা সরানো গেলেও, সব সময় সেই সুযোগ নাও পাওয়া যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, আমাদের চারপাশে অসংখ্য শাহেদ সক্রিয়।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী