নিজস্ব প্রতিবেদক
গত বছরের অক্টোবরে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তি করায় এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনালে। মামলাটি করেছে গাইবান্ধা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি শেখ রোহিত হাসান রিন্টু। রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক ড. আব্দুল মজিদ মামলাটি আমলে নিয়ে গাইবান্ধা সদর থানা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত আসামী গ্রেফতার হয়নি।
সম্প্রতি কুড়িগ্রামে জাতীয় পার্টির প্রার্থী পনির উদ্দিন আহমেদ এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে কটুক্তিমুলক বক্তব্য দেন। তবে সেক্ষেত্রে কোন মামলা হয়নি। এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছে কুড়িগ্রাম জেলা যুবলীগ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তি করেছেন পটুয়াখালী জেলা পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ আ’লীগ নৌকা মার্কার প্রার্থীর উপজেলা শাখার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মাইনুল ইসলাম রনো। তার প্রতিবাদে গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় আ’লীগের শ্রম উপকমিটির সদস্য কামরান শহীদ প্রিন্স মহব্বত তার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন। এক্ষেত্রেও কোন মামলা হয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের ২০২৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে সরকারের সমালোচনা করার জন্য মানুষকে গ্রেপ্তার করে ভিন্নমত দমন করেছে এবং সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলীয় সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকারকে ক্ষুন্ন করেছে। সরকার বরাবরই বাক স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছে। কারো বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মামলা করেনি। মামলা হয়েছে ব্যক্তিপর্যায়ে। দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৫ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি কোন ওয়েবসাইট কিংবা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণু করে বা বিভ্রান্তি ছড়ায় কিংবা একই উদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সেটি অপরাধ। দেশের আইন অনুযায়ী যে কেউ মামলা করতে পারে। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসে। এই নির্বাচনের ওপরে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়ায় আস্থা না থাকার কারণে প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল। অথচ বিএনপি এবং তাদের সহযোগী কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিতে। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কোন সুযোগ নেই। সেটি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন আছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া আর তাতে একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকায় সংবিধান লঙ্ঘন করা হতো। এছাড়া পশ্চিমা কয়েকটি দেশ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং বিভিন্ন দেশ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলেছে। তাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই দাবিও মিথ্যা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ভয় ভীতি দেখানো হচ্ছে। যা একেবারেই বানোয়াট। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। আর সেটি রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজেদের মধ্যেই। অনেক গণমাধ্যমে এই বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন এসেছে। অনেক আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমেও বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সরবরাহ করার জন্য অস্ত্রের কারখানাও ওই এলাকায় গড়ে তোলা হয়। স্থানীয় নাগরিকরা বরং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে ওই এলাকায় আতংকে আছে।
কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী জানান, আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে বিষয়টি জানিয়েছি। আপাতত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।
আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, ২০১৭ সালের আগেও ক্যাম্পের আশেপাশের এলাকায় মাদকের এত বিস্তার ছিল না। রোহিঙ্গারা আসার পর মাদকের বিস্তার বেড়েছে। আর এই মাদকের কারণে অস্ত্রের ব্যবহারও বাড়ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সীমান্তের এত কাছে যে, অপরাধীরা কোনোভাবে সীমান্ত পার হলেই এদের ক্যাম্পে চলে আসে। আর কোন সন্ত্রাসী যদি ওই ক্যাম্পে একবার ঢুকে পড়ে তাহলে তাকে ধরা বেশ কঠিন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচনের আগে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর ৮ হাজারেরও বেশি নেতা ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে, যেন তাদেরকে প্রতিযোগিতায় অক্ষম করা যায় এবং বিরোধী নেতাদের অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা যায়- সে চেষ্টা করা হয়। এটি আরেকটি মিথ্যাচার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট মামলার প্রেক্ষিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তার মধ্যেও অনেকেই জামিনে বাইরে আছেন।
বাংলাদেশী মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, নিরাপত্তাবাহিনী ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ টিরও বেশি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগের উদ্বেগজনক বৃদ্ধিও লক্ষ্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন নামক একটি সশস্ত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসার পর জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এটি আরেকটি মিথ্যাচার। বাংলাদেশে ‘জোর করে গুমের’ শিকার ৭৬ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। কিন্তু এই তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির গ্রহণযোগ্যতাকে। তালিকায় থাকা ৭৬ জনের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশে বসবাস করছে যার প্রমাণ মিলেছে। আবার অনেক তালিকাভুক্ত পলাতক আসামির নাম রয়েছে এখানে। যার কারণে যেই এনজিওগুলোর ওপর নির্ভর করে জাতিসংঘের প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, সেই এনজিওসহ প্রশ্ন উঠছে খোদ জাতিসংঘের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন তুলেছেন জাতিসংঘের তালিকা নিয়ে। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ তাহলে তদন্ত করে না কেন? ভয়েজ অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, এ রকম অভিযোগ অনেকে অনেক কিছু দেয় কিন্তু তার কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। কোনো নাম দিতে পারে না, কোনো কিছুই দিতে পারে না।
‘অনেক সময় দেখা যায়, বলা হচ্ছে অমুক লোক নাই কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সে ঠিকই জীবিত আছে। আবার কেউ অনেক সময় নিজেরাই পালায়। অনেক সময় ধার-কর্য করে নিজেরাই লুকিয়ে পড়ে; সে ধরনের ঘটনাও আছে। প্রত্যেকটা কিন্তু খোঁজ করে বের করা হচ্ছে,’ বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে এতগুলো নাম দেওয়া হলো, তার মধ্যে কয়েকটা ঘটনাই পাওয়া গেছে সত্য। সেগুলোর সম্পর্কে ঠিকই রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। আর রিপোর্ট দেওয়া হলো না কেন নিজেরা তারা তদন্ত করে দেখুক। নিজেরা তদন্ত করে না কেন, সেটাই তো আমার প্রশ্ন। সেটা করুক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানি, নজরদারি এবং আটক করা হচ্ছে। অথচ শুধুমাত্র মিথ্যা তথ্য প্রচার করার জন্য মানবাধিকার কর্মী আদিলুর এবং নাসিরউদ্দিন এলানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতেও প্রমান হয়েছে। আর তাতে আদালত দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। যদিও রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে এখন জামিনে বাইরে আছেন আদিলুর এবং এলান।