মোহাম্মদ নাসির হুসেইন

১৯৭১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধীন সময়গুলো  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপথ পরিবর্তন এবং স্থিতিস্থাপকতার যাত্রাকে প্রতিফলিত করে। ১৯৭১সালে একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীনতার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা, প্রাথমিক বছরগুলি পুনর্গঠন প্রচেষ্টা এবং জাতি গঠন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল।১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে, দেশটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, খাদ্য ঘাটতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো সমস্যাগুলির সাথে মোকাবিলা করেছিল।

সরকার অবশ্য শিল্পায়ন ও কৃষি উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেছে। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং মূল শিল্পের প্রচারের লক্ষ্যে নীতিগুলি ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মঞ্চ তৈরি করে।১৯৯০ এর দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সাক্ষী ছিল, আওয়ামী লীগ সহ পরবর্তী সরকারগুলো বাজার-ভিত্তিক সংস্কার গ্রহণ করে। এই যুগে বিদেশী বিনিয়োগ, বাণিজ্য উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণ প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দশকের শেষদিকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসা এই সংস্কারগুলিকে আরও এগিয়ে নিয়েছিল, যা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে অবদান রাখে।

২০০০ এর  প্রথম দিকে  দিকে ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের উপর ফোকাস করার সাথে একটি টার্নিং পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী মোকাবেলার উদ্যোগে সামাজিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট ছিল। ২০০০ সালের শেষদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির সূচনা একটি প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এবং ডিজিটালভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে।

২০০৯ সাল থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের একটি উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা অনুসরণ করে। পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পগুলো দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক নতুন যুগে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ঘটে, যা বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারকদের মধ্যে একটিতে পরিণত করে।চ্যালেঞ্জ, তবুও, অব্যাহত ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতির উদ্বেগ এবং পরিবেশগত সমস্যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবুও, সরকারের স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজিত নীতিগুলি এই চ্যালেঞ্জগুলিকে নেভিগেট করতে সাহায্য করেছে।২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সরকার ব্যবসা এবং ব্যক্তিদের সমর্থন করার জন্য উদ্দীপনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে, সংকটের সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে।সংক্ষেপে, ১৯৭১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনের সময়গুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির বহুমুখী যাত্রা প্রতিফলিত করে। যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক উদারীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন এবং অবকাঠামো প্রকল্প, ট্র্যাজেক্টোরি চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করার জন্য জাতির স্থিতিস্থাপকতা এবং সংকল্প প্রদর্শন করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন, তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি বলতে কিছুই ছিল না। রাস্তাঘাট, রেললাইন, সেতু, কালভার্ট, বন্দর প্রভৃতি বিধ্বস্ত। ব্যাংকগুলো টাকা শূন্য। তদুপরি দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাবারের ব্যবস্থা, প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংক পুনর্গঠন, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা ইত্যাদি কাজ করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে।এ ছাড়া জাতীয় সংসদ সচল করা এবং গণপরিষদ প্রতিষ্ঠা করে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ, দেশ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, ১০ মাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়ন প্রভৃতি গুরুদায়িত্ব পালন করে বঙ্গবন্ধুর সরকার।

নানা ধরনের অর্থনৈতিক সংকট, অনিয়ম-দুর্নীতি মোকাবিলা করে দেশকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের রূপরেখাও তিনি প্রণয়ন করেছিলেন।এ রূপরেখার প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এ পরিকল্পনায় তিনি কৃষি, শিল্প উৎপাদন এবং স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি জোর দেন। কৃষির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ শিল্প উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া হয়। কিছু অসৎ ব্যক্তি ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ১৯৭৪ সালে দেশের কোনো কোনো স্থানে সাময়িক দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেও অল্প সময়ের মধ্যে এটি মোকাবিলা করে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করতে পেরেছিলেন। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতা অর্জনের সময়ে দেশের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ৯৪ ডলারের মতো, সেখানে ১৯৭৫ সালে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে ২৭৩ ডলারে দাঁড়ায়। 

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হয়। পরবর্তীকালে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর আরও দুবার নির্বাচনে জয়লাভ করে চতুর্থ মেয়াদে (টানা তৃতীয় মেয়াদে) শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার শাসনামলে বিগত ১৩ বছরেই অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকের নানা ক্ষেত্রে আগের তুলনায় প্রভূত উন্নতি হয়েছে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ‘দিনবদলের রূপকল্প-২০২১’ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যে রূপকল্পে উল্লেখ ছিল বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার অঙ্গীকার। ২০১৮ সালেই বাংলাদেশ ‘স্বল্পোন্নত’ দেশের ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশের ক্যাটাগরিতে উন্নীত হয়েছে।২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিগত ১৩ বছরের গড় অর্জন, এর আগের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হয়েছে।

২০০১-২০০৬ সালে যেখানে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে ২০০৯-২০২১ সালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় ২০২১ সালে এসে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ১৯৭৫ থেকে এ পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার ৭৩ শতাংশই ঘটেছে গত ১২ বছরে। আইএমএফের হিসাব মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।অবশ্য ২০১৫ সালেই আমাদের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৩  সাল শেষে মোট জিডিপি ৪২৫  বিলিয়ন ডলারে উন্নীত  প্রক্ষেপিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায় যা ২০২৩ এ এসে দাঁড়ায় ১৮.৭ শতাংশ  চরম দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালের ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ২০১৯ সালে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে এবং ২০২৩ এ তা দাঁড়ায় ৫.৬ শতাংশে।

সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের ফলে তৈরি পোশাক, খাদ্য-পানীয়-তামাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ভোজ্যতেল, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল প্রভৃতির উৎপাদন বেড়েছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ও রপ্তানি উভয়ই সম্ভব হচ্ছে।

দেশে ২০১৯ সালে জিডিপিতে শিল্পের অবদান প্রায় ৩৫ শতাংশে পৌঁছে এবং ২০২৩ এ তা ৩৭.৫৬ শতাংশে দাঁড়ায়। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের প্রসারের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়।

সরকারি খাতে বর্ধিত বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশে বৈদেশিক সহায়তা ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়নে কোনো সমস্যাই হয় না। এ ছাড়া বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগেও আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হবে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৪২ বিলিয়ন (৪,২০০ কোটি) ডলার। করোনাকালীন ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল, তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে অনুমিত ছিল আর ২০২৩ সালের অনুমিত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৫৮ বিলিয়ন ডলার।  প্রায় দুই দশক ধরে রপ্তানি আয়ের ৮০-৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বেসরকারি উৎপাদকদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে সরাসরি বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুবিধার্থে সরকার বিশেষ আইন প্রণয়ন করে, যাতে ভবিষ্যতে সরকারের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। উদ্যোক্তাদের উৎপাদনের শুরু থেকে ১৫ বছরের কর মওকুফ করা হয়। এ ছাড়া কারখানা, প্ল্যান্ট স্থাপন ও যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি আমদানিতে শুল্ক মওকুফ করা হয়।

সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়। সরকারি-বেসরকারি উৎপাদনের সমন্বয়ে দেশ এখন বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ২০০৪-০৫ সালে যেখানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট, যেখানে ২০২০ সালে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াট।বর্তমানে দেশে ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।

দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে আরও ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। রাশিয়া থেকে কমবেশি ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তায় রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। এতে দুটি ইউনিটে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত একটি ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন সম্ভব হবে।

পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবার পর আরও ১০-১২টি মেগা প্রকল্প দেশি-বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। এদের মধ্যে কর্ণফুলী টানেল( ২০২৩ এ চালু হয়েছে) ঢাকা মেট্রোরেল(২০২৩ এ চালু হয়েছে), ঢাকায় দুটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে( একটি  চালু হয়েছে ২০২৩ এ),রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প,পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।। শুধু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে দেশের মোট জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি  প্রক্ষেপিত হয়েছে। সুতরাং আরও কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে।

মেগা প্রকল্পগুলোর বাইরে চলছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ। এসব অঞ্চলকে ঘিরে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে শিল্প বিপ্লব ঘটবে। সামগ্রিক অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাড়তি ৪০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

বিবিএস এর শিল্প উৎপাদনসূচক অনুসারে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২২) বৃহৎ ও মাঝারি ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প উৎপাদন সূচক পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের উৎপাদন সূচকের তুলনায় ৭.৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ডলার সংকট প্রশমন, মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া, ব্যাংকিং খাত ঠিক রাখা, রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সরকারের ক্রমাগত পদক্ষেপে চ্যালেঞ্জসমূহ  প্রশমনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক-২০২৩ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। এই তালিকায় এবার ১৪ ধাপ উন্নতি করেছে বাংলাদেশ।

২০২৩ সালের সূচকে ৫৪.৪ পয়েন্ট স্কোর পেয়ে ১৭৬টি দেশের মধ্যে ১২৩তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু করেছে ২০২২ সাল থেকেই,;ঢাকায় মেট্টোরেল চলছে কর্ণফুলী টানেল খুলে দেয়া হয়েছে ;এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। ফলস্বরূপ  বাংলাদেশে উন্নয়নের এক নতুন ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির দিগন্ত বদলে গিয়েছে এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং সাহসী নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে শূন্য হাতে, ধ্বংসস্তূপ থেকে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে তারই কন্যা শেখ হাসিনার চেষ্টায় ও নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বানায়, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে দেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখায়।

বাংলাদেশ এখন দ্রুত উন্নয়নশীল প্রথম পাঁচটি দেশের একটি। আর্থসামাজিক খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থান ও অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম।

ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল-২০২১’-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক অগ্রগতি এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫টি বড় অর্থনীতির একটি হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। উন্নয়ন গবেষকরা আজকের বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল, ‘এমার্জিং টাইগার’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’ প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করছেন।

২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এই সময়কালে, সরকার বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে যা দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া। আওয়ামী লীগ সরকার রাস্তা, সেতু, বন্দরসহ অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নীতকরণে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এটি শুধু দেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগ উন্নত করেনি বরং ব্যবসা-বাণিজ্যকেও উন্নত করেছে।

উপরন্তু, সরকার টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পের সম্প্রসারণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালক। ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেশটি টেক্সটাইল এবং পোশাক তৈরির জন্য একটি বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের জন্য বাস্তবায়িত হয়েছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির মতো উদ্যোগগুলি চালু করা হয়েছে উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে উত্সাহিত করা হয়েছে এই সময়ের শেষভাগে, কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব সহ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অর্থনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় প্রশমিত করতে উদ্দীপনা প্যাকেজ দিয়ে সাড়া দিয়েছে, ব্যবসা এবং দুর্বল সম্প্রদায়কে সহায়তা করছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধীন সময়কাল গুলোতে  বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন, মূল শিল্পের উপর ফোকাস, এবং সামাজিক কল্যাণমূলক উদ্যোগগুলি প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামীলীগ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পসমূহ  বাস্তবায়নকালে এবং বাস্তবায়ন-পরবর্তী সময়ে দেশের কর্মসংস্থান, রাজস্ব আহরণ, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং ভোগ চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিগত পনেরো বছরে অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক নানান উত্থান-পতন ও চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এগিয়েছে এ দেশের অর্থনীতি এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মান।বিগত ১৫ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, চিকিৎসা ও নাগরিক সুবিধার প্রসারণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন,শিল্পায়ন চলমান থাকলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, দেশি বিনিয়োগ,এবং বিদেশি  বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়বে। তাই সরকারের চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন,রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন, সহ বিশ্বের বুকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন সহ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল করতে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে রাষ্ট্র  পরিচালিত হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক,  অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।