ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী

২০২৩ সালে দেশ ও বিদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও মহল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। তৈরি হয় আশা ও শঙ্কার। নানা অপপ্রচার, গুজব, মিথ্যাচারসহ সর্বোপরি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার দৃশ্যমান ও ধ্বংসাত্মক বিভিন্ন প্রয়াস মাথাচাড়া দেয়।

বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং উন্নয়ন-বিরোধী একটি চক্র ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নির্বাচনে কূটকৌশল অবলম্বন বা কারচুপির মাধ্যমে কিংবা পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে তারা আটঘাট বেধে মাঠে নামে।

সফল না হলে দেশ ও জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধ স্পৃহায়। অগ্নি-সন্ত্রাস, যানবাহন পোড়ানো ও ট্রেনে অগ্নিসংযোগ, বোমাবাজি, নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ঘরবন্দি করতে চায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং অপতৎপরতার অংশ হিসেবে এবার বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ানো হয়েছে।

বিএনপি, জামাত ও তাদের সমমনা দলগুলো এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি এবার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ধারাকে নস্যাৎ করার মুখোশের আড়ালে নির্বাচনকে বর্জন ও প্রতিহত করার ডাক দিয়ে ধারাবাহিক অবরোধ, হরতাল, লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল করেই ক্ষান্ত হয়নি।

উপরন্তু, তথাকথিত আন্দোলনের নামে মানবতাবিরোধী বর্বর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে অগ্নিসন্ত্রাস, জাতীয় সম্পদের বিনাশ, যানবাহন ও ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করার মতো ধ্বংসাত্মক দুষ্কর্মে মেতে ওঠে। দিনে-দুপুরে সাধারণ মানুষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদেরকে হত্যা করার মতো নিষ্ঠুর ও নির্মম কাজে জড়িয়ে পড়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা জলজ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার মতো জঘন্য অপরাধের নজীর সৃষ্টি করেছে।

অন্যদিকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলা ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে দলমত নির্বিশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দল ও মতের মানুষদের অংশ গ্রহণের জন্য উদার আহ্বান জানান।

সেই সাথে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, জনগণের ভোটের ফলাফলকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে সকল মহলেই সেই রায়কে গ্রহণ করবে এবং তার ভিত্তিতে গঠিত সরকার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাড় করাবে।

সকল মিথ্যাচার, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র, গুজব, ভয়, শঙ্কা ও অনুমানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ৭ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার এ দেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচনের ইতিহাসে সৃষ্টি হলো এক অনন্য ও মহিমান্বিত দৃষ্টান্ত এবং নতুন ইতিহাস।

বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বাধিক প্রার্থীর অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও অবাধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪ ছিল দেশ ও বিদেশের জন্য এক বিস্ময়। সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমন্বিত প্রয়াস ও সংগ্রাম সফল হলো-জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

এখানে সাংবিধানিক পন্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান অনুসারে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নন্দিত হলো এবং বিশ্ব পরিসরে স্বীকৃতি পেলো।

জনগণ নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে আমার ভোট আমি দিব যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিব-এ অভিধার সার্থক বাস্তবায়ন করে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করে। এভাবে এদেশের মানুষ বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কন্যায় আস্থা স্থাপন করে দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়কে আরও শক্তিশালী করলো।

এ ভোট প্রদান ছিল ভয়ভীতিহীন, অবাধ, চাপমুক্ত ও নিরপেক্ষ। ফলে ভোটার তার গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন ও সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি উপর দাড় করার আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো।

আজ জাতির প্রত্যাশা এই যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের আলোকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকর করা ও গণতান্ত্রিক ধারায় দেশ পরিচালনার পথ নিশ্চিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।

৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী ও ঐতিহাসিক সংগ্রামের এক বিশাল স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও সংসদীয় নির্বাচনের আগামীর পথ চলার এক মাইল ফলক।

যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। সকলেই বিশ্বাস করে জনগণের শক্তি ও সমর্থন হচ্ছে গণতন্ত্রের ভিত্তি। জনগণই ক্ষমতার উৎস। এবার জনগণের ভোটাধিকার সাংবিধানিক পন্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে সমর্থন করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাতকে শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতায়ণ করেছে।

তাই বঙ্গবন্ধুর কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে-এমনটাই আজ সকলেই প্রত্যাশা করে।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সিনেট সদস্য ও সদ্য-সাবেক প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।