নিজামুল হক বিপুল
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ’৮০ দশক থেকে বি্এনপি একটি শক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিল। যেটি বরাবরই এন্টি আওয়ামী লীগ এবং ভারত বিদ্বেষি। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধী মনোভাব তৈরির প্রক্রিয়া। খুবই ঠাণ্ডা মাথায় দেশের মানুষকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়। এজন্য স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয় সাধারণ মানুষের সামনে। ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, বাসন্তীর কথিত জাল পরা ছবিসহ এরকম আরও অনেকগুলো নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়। যেটি সাধারণ মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করতে ভূমিকা রাখে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যে চরিত্র অর্থাৎ সংবিধানের যে চারটি মূলনীতি সেগুলো বদলে দেওয়ার কাজে হাত দেয় বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক সরকার ও সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। জেনারেল জিয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা করেছিলেন সেটি হলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে দেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীসহ উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠির রাজনীতি উম্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। দেশে জঙ্গিবাদের বীজও তখন থেকেই বপন হতে থাকে।
এটি করেছিলেন তিনি নিজের স্বার্থে, যাতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন এবং দেশটাকে আবারো পিছনের দিকে অর্থাৎ পাকিস্তানি ভাবধারায় টেনে নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, একাত্তরের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী শর্ষিনার পীরকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধেকে কলংকিত করেছেন।
তার এই কৌশল ছিল মূলত আওয়ামী লীগকে ঠেকানো। যে রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তাদেরকে নিশ্বেষ করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে জিয়া ঠাণ্ডা মাথায় দেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী প্ল্যাটফর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন।
ওই সময় থেকে বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগের প্রতি চরম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। একই সঙ্গে একটা প্রচার জোরেশোরে চালানো হয় যে, আওয়ামী লীগ কখনও এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশটা ভারতের অঙ্গরাজ্যে রূপ নেবে। বাংলাদেশীরা ভারতের দাসত্বে পরিণত হবেন।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে বীজ বপন করা হলো সেটি চলতে থাকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। এখনও যে চলছে না তা নয়। এখনও এই প্রচার চালানো হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারতের তাবেদারে পরিণত হয়েছে। যদিও এটি হালে পানি পাচ্ছে না।
১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশবাসীর সিংহভাগের ধারণা ছিলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ছিল তার বিপরীত। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। এতে জামায়াতের সমর্থন ছিলো।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা থাকার পরও নির্বাচনে জিততে না পারার মূল কারণ ছিলো আওয়ামী লীগ বিরোধী প্ল্যাটফর্ম। যারা কৌশলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার চালিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম অপপ্রচার ছিলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশটা ভারত হয়ে যাবে। ভারত বিরোধী একটা প্রচার প্রপাগাণ্ডা ছিলো। যেটি বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলো চালিয়েছিল এবং নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
বিরোধী রাজনৈতিক জোটের আন্দোলন ও গণদাবির মুখে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারীর ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদে তত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে তত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
এরপর বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্ববাধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। ওই নির্বাচনেও আওয়ামী বিরোধী শক্তি একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানামুখি প্রচার চালায়। দেশ ভারত হয়ে যাবে, মসজিদে উলুধনি শোনা যাবে, বাংলাদেশ তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এরকম আরও বহু অপপ্রচার চালানো হয়।
২০০১ সালে এসে প্রথমবারের মত আওয়ামী লীগ স্বতঃস্ফুর্তভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিনের মেয়াদে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটে। তারা মাত্র ৫৮ টি আসন পায়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পুরোনো অপপ্রচার যেমন ছিলো, তেমনি রাষ্ট্রের সকল শক্তিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিলো।
কিন্তু ২০০৬ সালে বিএনপি কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। যার ফলে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসে। দুই বছর মেয়াদি এই সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। তারপর থেকে গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে।
আওয়ামী লীগকে হঠাতে বিএনপি-জামায়াত জোট গত ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়া তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের নামে দেশজুড়ে নারকীয় তাণ্ডব শুরু করে। অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশকে নরকে পরিণত করে। অপরদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ি ২০১৪ সালে যথা সময়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। বাকী ১৪৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আবারও সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিতে ব্যর্থ হয়। তারপর থেকে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত বছর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন বিএনপির সাত জন সংসদ সদস্য। বিএনপি-জামায়াত জোট ও সমমনা দলগুলো সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। তাদের সাফ কথা, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে তারা অংশ নিবে না। কিন্তু বিএনপির তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে কোনোরকম আমলে না নিয়ে সরকার সংবিধান অনুযায়ি যথাসময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে হাঁটতে থাকে। আর বিএনপি হাঁটে উল্টো পথে।
দলটি তাদের জোট শরিক জামায়াত ও সমমনা দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করে। তার আগে গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। ওই দিন সমাবেশকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় বিএনপি। সেটি রূপ নেয় ব্যাপক সহিংসতায়। মারা যান পুলিশ সদস্য। হামলা হয় সাংবাদিকদের উপর। মারা যান এক যুবদল কর্মীও। ওই দিনের সমাবেশ থেকে বিএনপি পরদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচী ঘোষণা করে। তারপর থেকেই লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দিতে থাকে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের জোট শরিকরা।
এরমধ্যেই ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ি গত ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোট ও তাদের শরিকরা নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। কিন্তু তাদের কোনো আন্দোলনেই জনসম্পৃক্ততা না থাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে।
এই নির্বাচনের পরে এখন বিএনপির অবস্থা খুবই নাজুক। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিএনপির নেতৃত্ব শূন্যতা এবং অপরিপক্ষ ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত দলটিকে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি যে ভিত্তির উপর দাাঁড়িয়ে গত চার দশক ধরে রাজনীতি করে আসছিল তাতে মারাত্বক চির ধরেছে। বিশেষ করে এন্ট্রি আওয়ামী লীগ যে প্ল্যাটফর্ম এবং ভারত বিদ্বেষ- সেটি কার্যত নির্বাচনের সময় কাজে লাগলেও সরকারি বিরোধী আন্দোলনে তার কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির বড় পুঁজি দেশবাসীকে আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং ভারত বিরোধী করে তোলা। যেটি নির্বাচনের সময় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে দলটি এবং তার সমমনারা। কিন্তু রাজপথের আন্দোলনে তারা কোনো ইস্যুকেই ক্যাশ করতে পারেনি। ফলে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা দেখা যায়নি।
এই অবস্থায় বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে রীতিমত উদ্বিগ্ন দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। দলের শীর্ষ নেতারা যেভাবে জোট শরিকদের স্বান্তনা দিয়েছেন তাতে এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপি মনে করছে, তারা যে ভোট বর্জনের আহবান জানিয়েছিল তাতে জনগণ সাড়া দিয়েছে। কিন্তু তাদের এই দাবি একেবারেই আপেক্ষিক। কারণ নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে।
এতে করে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং দলটির জোট শরিকদের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। আপাতত তারা সরকার পতনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করেন, দলটির বিদেশ নির্ভর রাজনীতি তাদেরকে সাংগঠনিকভাবে একেবারেই শেষ করে দিয়েছে। তাই আগামী দিনগুলোতে বিএনপির রাজনীতি কেমন হবে তার কোনো স্বচ্ছ ধারণাও দিতে পারছেন না দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।