ড. ফারজানা মাহমুদ

নেতিবাচক ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, জঙ্গি উত্থান, প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিপরীত দিকে চালিত করার চেষ্টা করছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সারাদেশে আওয়ামী লীগের কর্মীদের উপর নির্বিচারে সহিংসতা চালিয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন করেছে নজিরবিহীন ভাবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাধা দিতে পেট্রোল বোমা ও অগ্নিসন্ত্রাস করে দলটি ৪০০ এর বেশি ভোট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত প্রাইমারি স্কুল আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ২০১৩-১৫ সালে বিএনপি জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে ৫০০ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান, ৩৫০০ জন আহত হন। যানবাহন পুড়ে যায় ৮১৩টি।

২০২৪ এর নির্বাচন বানচালের জন্য কিছুদিন আগেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে পেট্রোল বোমা ছোঁড়ে বিএনপি, এতে মায়ের বুকে থাকা শিশুসহ আগুনে পুড়ে চারজন মারা যান। সাধারণ জনগণকে ভোট না দেওয়ার জন্য নির্বাচনবিরোধী প্রচার চালাচ্ছে দলটি। ভোট বর্জনের আহবান জানিয়ে টানা গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণের পর ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে হরতালের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। ভোটের আগের দিন থেকে হরতাল শুরু হয়ে ভোটের দিনসহ পরদিন সকালে সেই হরতাল শেষ হবে। জামায়াতে ইসলামীও পৃথকভাবে শনিবার থেকে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে। বিএনপির পাশাপাশি আন্দোলনে অন্যান্য শরিক দলগুলোও অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের এই অধিকার নিশ্চিত করে যে, জনগণ তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি তাদের পছন্দ অনুসারে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করতে পারে। সংবিধানের ৭(১) এবং (১১) নম্বর অনুচ্ছেদ নাগরিকদের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আবার সংবিধানের (১২২) নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ এর ৭ ধারা ১৮ বছরের বেশি বয়সী প্রতিটি নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচন মূল ভিত্তি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনীতি চর্চার মূল লক্ষ্য। গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন জনগণের স্বাধীনভাবে এবং স্বেচ্ছায় জনপ্রতিনিধি বেছে নেয়ার এবং ভোট দেয়ার অধিকার থাকে।  নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করার সিদ্ধান্ত যে কোনো রাজনৈতিক দল নিতেই পারে, কিন্তু নির্বাচন বর্জনের জন্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, জনগণকে সহিংসতার ভয় দেখানো বা নির্বাচনের দিন হরতাল দিয়ে জনগণের ভোট অংশগ্রহণ বাধা দেয়ার অধিকার কোন রাজনৈতিক দলের নেই। বিএনপির নির্বাচনবিরোধী প্রচার ও হরতালের ঘোষণা গণতন্ত্রের চর্চাকে বাধা দেয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে একটি বড় ধরনের অপরাধ, এটি ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ।

নির্বাচনে ভোটাররাই মূল চালিকা শক্তি এবং ভোটের পুরো আয়োজনটাই ভোটারদের জন্য। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমান ভোটাধিকার রয়েছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেয়ার অধিকারও নাগরিক অধিকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবির মতে, গণতন্ত্রে ভোটাধিকার একটি অতি মূল্যবান অধিকার এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও। নাগরিকের এই অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ধরা হয়। অনেক দেশে ভোট দেয়া নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক। অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে নাগরিকদের কেউ ভোট দিতে না গেলে তাদেরকে জরিমানা করা হয়।  যদি কেউ ভোট দিতে আগ্রহী না হন তবে আগে থেকেই তা নির্বাচন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়।

আমাদের দেশে ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। ভোট দেয়া-না দেয়া ভোটারের নিজস্ব ইচ্ছা। দণ্ডবিধি ১৮৬০, ধারা ১৭১(ক) অনুসারে, ভোটাধিকার বলতে একজন ব্যক্তির ভোট দেয়া কিংবা ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকার অধিকারকে বোঝানো হয়। সুতরাং, ভোট দেয়া থেকে যেমন কাউকে বিরত রাখার চেষ্টা করা যাবে না, একইভাবে ভোট না দিতে চাইলেও কাউকে জোর করা যাবে না। দণ্ডবিধির ধারা ১৭(গ) অনুসারে, প্রার্থী বা ভোটার বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির বা সম্পত্তির যদি কেউ ক্ষতি করার হুমকি দেয়, তাহলে সেটি অনুচিত প্রভাব বলে গণ্য করা হবে।

ভোট দিতে বা ভোট না দিতে বাধ্য করার জন্য কেউ যদি ভোটারকে কিংবা তার পরিবারের কাউকে হয়রানির হুমকি দেন কিংবা তার সম্পদের ক্ষতি করতে চান, তবে তা অনুচিত প্রভাবের আওতায় পড়বে। দন্ডবিধির ১৭১(চ) ধারা অনুসারে, এ ধরনের অনুচিত প্রভাবের জন্য কোনো ব্যক্তির এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা আর্থিক দণ্ড বা উভয় দন্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭৪ এর ৭৭(৩) ধারা অনুযায়ী, অপহরণ, বলপ্রয়োগ বা কোনো প্রতারণামূলক কৌশল বা ফন্দি করতে সাহায্যে, ভোট দিতে অসুবিধা সৃষ্টি বা বাধা দেয়া, কোনো ভোটারকে ভোট দেয়ায় বিরত থাকতে বাধ্য, প্ররোচিত বা উদ্বুদ্ধ করাও অপরাধ।

বিএনপি-জামাতের হরতালের উদ্দেশ্যই থাকে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত করা। বিএনপি-জামায়াতের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যেই রাখা হয়েছে। বিএনপি- জামায়াতের সহিংসতার রূপ যারা দেখেছেন তারা হরতালের কারণে ভোট দিতে যেতে ভয় পেতে পারেন কিংবা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। হরতাল ডেকে ভোটারদের ভোটদিতে বাধা দেয়ার এই চেষ্টা আইনসঙ্গত নয়।  বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুসারে, কাউকে ভোটদানে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা, ভয় ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে অনুৎসাহিত করা অপরাধ।

রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তির ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের যে সম্পর্ক সেটি অনুযায়ী, ব্যক্তির ভোটদানের এই মৌলিক অধিকারকে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী কোনো অবস্থাতেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। তাই বিএনপি-জামায়াত বা কোনো অপশক্তি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন করলে বা অধিকারগুলো প্রয়োগে বাধা দিলে প্রত্যাশা করি রাষ্ট্র কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

লেখক: গবেষক ও আইনজীবী।