অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন

৭ জানুয়ারি, রবিবার সকাল ৮.০০ ঘটিকা হতে বিকাল ৪.০০ ঘটিকা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। ১৫ নভেম্বর, ২০২৩ নির্বাচনী তফশিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গেছে। যদিও, অনাকাঙ্খিতভাবে বিএনপিসহ গুটিকয়েকটি দলের বর্জনের মধ্যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

তবে, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দল এবং প্রার্থী ইতোমধ্যেই ঘোষিত তফসিলে বর্ণিত কর্মসূচি অনুযায়ী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ, জমা দান এবং প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছেন, যা অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ৩০০টি আসনের বিপরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ মোট ২ হাজার ৭১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৬৬ জন নিবন্ধিত ২৯টি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী এবং ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

উল্লেখ্য, পরিসংখ্যান অনুসারে মোট প্রার্থীর এক চতুর্থাংশই স্বতন্ত্র এবং প্রতি আসনে গড় প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। আশা করা যাচ্ছে, এই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন ভোটার। সর্বশেষ, ২ নভেম্বর ২০২৩ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত আসনভিত্তিক চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। তন্মধ্যে, পুরুষ ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯, নারী ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন এবং হিজড়া ভোটার ৮৫২ জন।

সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দেবেন এমন ভোটার সংখ্যা ১ কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৬ জন। জাতীয় সংসদের সর্বমোট ৩৫০টি আসনের বিপরীতে ৩০০ জন সাংসদ সরাসরি জনগণের ভোটে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। বাকী, ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে যা পরবর্তীতে জয়ী দলসমূহের মধ্যে সংখ্যানুপাতে বণ্টন করা হবে। আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে—এমন বিশ্বাস দেশের আপামর জনসাধারণের।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই চারিদিকে সন্তোষজনক পরিবেশ এবং উৎসবমুখর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ও প্রতীক বরাদ্দের পরই প্রচারণায় নেমেছেন প্রার্থীরা। প্রার্থীরা নিজস্ব প্রচার-প্রচারণায় নানামুখী ইতিবাচক কৌশল গ্রহণ করেছেন। গভীর রাত পর্যন্ত পাড়া-মহল্লার প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণসংযোগের জন্য প্রার্থী ও তার সমর্থকরা ছুটে বেড়াচ্ছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অতিশয় কৌতূহলী প্রচারণা চালিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। জনগণের আস্থা অর্জনে প্রত্যেক প্রার্থী নিজস্ব উদ্যোগে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন। এ সকল ইতিবাচক প্রচার কৌশল আপামর জনগণকে উজ্জীবিত এবং নির্বাচনমুখী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদানের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের পূর্বাভাস প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে। দেশের সকল নাগরিক বিশেষ করে প্রচলিত আইনে বয়স কাঠামোয় যোগ্যতাসম্পন্ন ভোটারগণসহ সবাই চায়, এমন উৎসবমুখর এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।

অতীতে বিভিন্ন সরকারের সময় নির্বাচন নিয়ে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার যে নজির রয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। আওয়ামী লীগ সরকারই ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদ শেষে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিকট নির্বিঘ্নে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিল। পরবর্তীতে সে নির্বাচনে কী হয়েছিল তা সবার অজানা নয়।

২০১৪ সাল থেকে বিএনপি এবং সমমনা দলসমূহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাতে থাকে। তারা মূল ক্রীড়নক হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়। অথচ এর অব্যবহিত পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার তথা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ সকল নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করে এবং এ সকল নির্বাচনে বিরোধী দলসমূহ খুব ভাল ফলাফল করে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এরকম সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের নজীর স্থাপন করা সত্ত্বেও তৎকালীন বিরোধী দল নির্বাচিত সরকারকে পদত্যাগ করে ‘নির্দলীয়’, ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং তা আজও অব্যাহত আছে। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এ দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে বাংলাদেশের সচেতন জনসাধারণ ও সুশীল সমাজের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।

আমাদের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সংজ্ঞায়িত করার অদ্ভুত রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে। নির্বাচনে জিতলে গ্রহণযোগ্য, না জিতলে অগ্রহণযোগ্য-এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে ভোটের সার্থকতা আসবে না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কেউ জিতবেন, কেউ হারবেন। যারাই জিতুক, শান্তিপূর্ণ ও অবিতর্কিত নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হলে দলের জয় গণতন্ত্রের জয় বলে প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমরা প্রত্যাশা করছি, কোনো রাজনৈতিক চাপে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা যেন বিতর্কিত না হয়।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু ২০২২ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য কোন আইনই ছিল না, অতীতে যে যার মত করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। এই সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিধান রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২ এনে, মহান জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পাস করে বিলটি আইনে পরিণত করেছে।

নির্বাচন কমিশন গঠন আইন তৈরি হওয়ায় বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণের নিয়োগদান স্বচ্ছ, ও নিরপেক্ষভাবে হয়েছে। দায়িত্ব পালনে এই নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই সংবিধান ও আইনের অধীন থেকে এই নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে, এবং এর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে জনস্বার্থ সমুন্নত হবে এটুকু আশা আমরা করতেই পারি।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সততা ও আন্তরিকতা ইতোমধ্যেই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক এবং সাধারণ ভোটারদের মধ্যে যথেষ্ট আশার সঞ্চার করেছে। আসন্ন অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে অর্থবহ করার জন্য মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকেও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য সতর্ক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং এর সঠিক বাস্তবায়নও আমরা দেখতে পাচ্ছি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ প্রয়োজনীয় লোকবলের রদবদল নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করেছে। নির্বাচনের দিনে সকালে ব্যালট পেপার পৌঁছানোর যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারও নির্বাচন কমিশনকে সকল ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। সকলের কাছে এটি এখন সুস্পষ্ট যে, বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ-দক্ষ নির্বাচন কমিশন সুন্দর একটি নির্বাচন উপহার দিতে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত।

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বারবার অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ২৩ নভেম্বর ২০২৩ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রধানমন্ত্রী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মন্তব্য করেন। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের ভোটের অধিকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রয়োগ করবেন। যাকে খুশি তাকে ভোট দেবেন, আমাদের সে বিষয়ে কোনো কথা নেই। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আমি আপনাদের কাছে দাবি করব আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ জনগণের ইচ্ছা, ভোটারের ইচ্ছা; যাকে খুশি তাকে দিতে পারেন। আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো, এটাই আমাদের স্লোগান।’

পরিশেষে বলা যায় দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলমান রাখার জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অপার-সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাড় করাতে দেশি-বিদেশি সকল মহলের সমর্থন প্রয়োজন। নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং নির্বিঘ্নে যেন ভোটাররা কেন্দ্রে আসেন সে বিষয়ে প্রার্থী এবং নির্বাচন কমিশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা দরকার। রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত ও সহিংসতামুক্ত রাখা গেলে ভোটার উপস্থিতি অবশ্যই বাড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তরুণ ভোটাররা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ভোটে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।  জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়ার স্বার্থে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দিতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। সেই লক্ষ্য অর্জনে সকল অশুভ অপতৎপরতাকে উৎখাত করে সুষ্ঠু, পরিচ্ছন্ন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করাই হবে সকলের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে এটুকুই আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা।   

লেখক: পরিচালক, আইকিউএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।