সৈয়দ মো. সিয়াম

বিশ্বের যা কিছু চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। একুশ শতকে নারী তার চলমান অগ্রযাত্রার মাধ্যমে তার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের এক অন্যতম রোল মডেল।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মানবসম্পদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে আমদের বিশাল জনসংখ্যা যাকে পুঁজি করে আমরা জনসংখ্যাকে পরিণত করেছি জনসম্পদ তথা মানব সম্পদে। আর এই বিশাল জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অংশ হলো নারী।

বিশ্বের যে দেশগুলো উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে তারা সকলেই সুগম করেছে তাদের নারীর ক্ষমতায়নের পথ। বর্তমান বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে।

একসময় সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারজনিত বাধার কারণে যেসব ক্ষেত্রসমূহে নারীর অংশগ্রহণ চিন্তাও করা যেত না সেইসব ক্ষেত্রসমূহ এখন সকলের জন্য উন্মুক্ত। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় নারীরা স্বাধীনভাবে এসব ক্ষেত্রে অংশ নিয়ে নিজেরা যেমন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন হলো দেশের উন্নয়ন কাজে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ। আজ প্রতিটি কাজে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রবাস, আইসিটি মোট কথা অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে।

বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশুর ভর্তির হার বেশি এবং বিগত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সব শিক্ষাবোর্ডেই মেয়েদের ফলাফল তুলনামূলক ভালো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে দীর্ঘসময় ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান অবধি দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা রয়েছে নারীরই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী শ্রমবাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর একটি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ। গ্রামীণ নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার শহরের নারীর তুলনায় বেশি।

আবার পোশাক খাত ছাড়াও এখন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, যোগাযোগ খাত, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং, ইনস্যুরেন্স খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মোট পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পোশাক খাতের পরই প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

সংসার পরিচালনার পাশাপাশি তারা চাকরি কিংবা ব্যবসা করছে। এছাড়া ঘরে বসে আজ ফ্রি ল্যান্সিং আর ই—কমার্সের যুগে নারীরা ব্যবসা করছেন। ২০১০ সালে যেখানে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল ১৬ দশমিক ২ লাখ সেখানে ২০১৬—১৭ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬ লাখ।

অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনাকারীর অর্ধেকই নারী উদ্যোক্তা। এই উদ্যোক্তারা নিজের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের বড় পেজ উইমেন অ্যান্ড ই—কমার্স ফোরাম (উই) পেজের সদস্য সংখ্যা ১১ লক্ষেরও অধিক। অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারাও। আবার কৃষি খাতেও নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো।

তবে এসব উন্নয়নের সূত্রপাত শুরু করতে প্রয়োজন হয় যোগ্য নেতৃত্বের আর তার পেছনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা তথা চালিকা শক্তির পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের পরপর তিনবারসহ মোট চারবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে নারীরা আজ সর্বত্রই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। সরকার প্রধান হিসেবে তিনি যেমন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে ঠিক তেমনিভাবে দেশের সব নারীসমাজ এগিয়ে যেতে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। জাতীয় সংসদে স্পিকার নারী, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে পুরুষের পাশাপাশি তিনি সুযোগ করে দিয়েছেন নারীদের আর সেখানে তারা তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলছেন প্রতিনিয়ত।

১৯৯৬—২০০১ মেয়াদের শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদকালেই সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার যেমন ধর্ষিতা নারীকে দোররা মারা (বেত্রাঘাত), মৌখিক তালাক ও হিল্লা বিয়ে ইত্যাদি সংক্রান্ত নারীর প্রতি সহিংসতা সৃষ্টিকারী কুপ্রথা যা অযোগ্য ব্যক্তিকতৃর্ক ফতোয়া প্রদানের মাধ্যমে কেবলমাত্র নারীর উপরে আরোপ করা হতো সেই ব্যাপারে হাইকোর্ট থেকে অযোগ্য ব্যক্তি কর্তৃক ফতোয়া প্রদান সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়।

বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পাচ্ছে। নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতির কারণে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণও বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারী—পুরুষ যখন একই পদবিতে কাজ করে তখন নারী—পুরুষের আয়ের বৈষম্য কমে আসছে।

সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার সংক্রান্ত শত বাঁধা—বিপত্তি পেরিয়ে নারী তার বিস্ময়কর বহুরূপী কর্মগুণ প্রতিভা প্রতিনিয়তই প্রকাশ করছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আর অতি ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্তরালে এককালে বিশ্বাস ছিল, নারী কোনোদিন ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। তার একমাত্র কাজ সন্তান লালন—পালন আর গৃহকর্মীর একপেশে দায়িত্বপালন।

বাইরের উৎসবে অংশগ্রহণ ছিল অলীক কল্পনা। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে বাসন্তী রঙা শাড়ি পরে স্কুটি চালাতে পারা নারীরও রয়েছে উৎসব—উল্লাসের স্বাধীনতা। তার পেছনে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকুক না সফেদ বিশ্ব। স্বাধীনতার ৫৩তম বর্ষে এসে সকল বাঁধা পেরিয়ে নারী এগিয়ে যাক তার আপন মহিমায় এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।