ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
নতুন বছরে আমাদের একটি অতি-প্রত্যাশিত জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিষয়বস্তু হল জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অত্যাবশক হাতিয়ার। একটি সাংবিধানিক কর্তব্য-ব্যাপারও বটে। সবার অংশগ্রহণে একটি মান্য ও কাম্য নির্বাচন আমাদের সবার জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিষয়। ১২-তম জাতীয় নির্বাচন এজন্যই আমাদের আগ্রহের একটি বিষয়।
নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রকাশিত ইশতেহার আমাদের হাতে এসেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইশতেহার-২০২৪ ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগও যারা বিগত দেড়-দশক ক্ষমতায় আসীন থেকেছে। আমরা ইতিপূর্বে বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে বিভিন্ন জাতীয় দলের নির্বাচনী ইশতেহার পাঠ করেছি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক বিশেষ রকমের দক্ষতা অর্জন করেছে। এই দলটি যে-ধরনের ইশতেহার ঘোষণা করে থাকে, তাতে সবসময়েই একটা গভীর গবেষণার ছাপ থাকে। বিভিন্ন নীতি, পরিকল্পনা, কর্ম-পরিকল্পনা ইত্যাদি সহযোগে যথেষ্ট গ্রাফচিত্রের উপস্থিতিতে একটি মনোজ্ঞ ইশতেহার আমরা পেয়ে থাকি। এর রচনা-শৈলী প্রায়শই সরকারের বিচিত পলিসি-পেপারের আদলে গঠিত হয়। এর সার্বিক পরিকল্পনা, শৈলী-নির্মাণ, গদ্য-কাঠামো রচনা এবং সার্বিক সম্পাদনায় যে-সুচারু ভাব থাকে তার জন্য প্রয়োজন একটি বড় গবেষণা-দল। আওয়ামী লীগ যে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এত সামর্থ্য প্রয়োগ করে সেটা একটা বিস্ময় জাগায়। পাশাপাশি এই আশা জাগায় যে রাজনৈতিক মাঠ-ভিত্তিক কর্মযজ্ঞ বা সরকার পরিচালনার ব্যস্ততা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ইশতেহারের জায়গায় একটা মননশীল গভীরতা আনতে সচেষ্ট থেকেছে।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারের মূল বাণীঃ “স্মার্ট বাংলাদেশ– উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান”। ইশতেহারে পাঁচটি স্তরে আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে – ১৯৭১ (রাজনৈতিক মুক্তির দর্শন), ২০২১ (অর্থনৈতিক মুক্তির দর্শন), ২০৪১ (সাংস্কৃতিক মুক্তির দর্শন), ২০৭১ (স্বাধীনতার শতবার্ষিকীতে সমৃদ্ধির দর্শন), ২১০০ (নিরাপদ ব-দ্বীপ)। এই ধাপগুলি অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং সু-গবেষিত। আগামী বছরগুলিতে, কিংবা এই শতাব্দীর শেষ-পাদ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা কী রূপ পেতে পারে, এবং তদনুযায়ী আমাদের কী ধরনের উন্নয়ন-ধাপ হওয়া উচিত তার একটি সুন্দর উপস্থাপন এই ধাপ-ওয়ারী ভবিষ্যত পরিকল্পনায় বিবৃত আছে। এই ধাপ আমাদের ভবিষ্যতেও কাজে লাগবে – আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক কি না-থাকুক। আমি নিশ্চিত, পরবর্তী পরিকল্পনাকারীরা এই ধাপ অনুযায়ী তাঁদের কল্পনাও সাজাবেন, হয়ত স্বীকৃতি দেবেন না। ফলে ইশতেহারের প্রথম পাতাতেই জাতীয় আকাঙ্ক্ষার আমরা একটা চমৎকার প্রতিফলন পেয়েছি।
এই ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছে – দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া; কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা; লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো; ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নিম্নআয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা; সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা; সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো। ইশতেহারে লেখা হয়েছে, টানা তিন মেয়াদে জনকল্যাণমুখী ও সুসমন্বিত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে-টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তার উপর ভর করে ‘উন্নত-সমৃদ্ধ-স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা হবে যার মূল কারিগর হবে সম্ভাবনাময় বিশাল তরুণসমাজ। নির্বাচিত হয়ে এলে ২০২৪-২৮ সালে কী ধরনের অগ্রগতি করা হবে তার অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ তাদের সু-লিখিত ইশতেহারে ব্যক্ত করেছে।
এই অগ্রগতির একটি মূল হাতিয়ার হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল। ইশতেহারে অঙ্গীকারের শুরুতেই উল্লিখিত হয়েছে “ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণ”। বলা হয়েছে, “আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল।… ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২৫, ২০৩১ ও ২০৪১-এর সময়রেখার মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত হয়ে তৈরি করবে স্মার্ট বাংলাদেশ। … স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক, জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিগত এবং উদ্ভাবনী”। ইশতেহারের ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তি সক্ষমতা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য আমরা ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ – এই চারটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দেই। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করছি।”
মূলত আধুনিক বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির সমবায়ে যে অভিনব ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তৈরির প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে তা আওয়ামী ইশতেহারের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি বিষয় ধরে ধরে উল্লেখ করার সুযোগ এই ছোট-পরিসরে নেই, কিন্তু আমরা যদি ইশতেহারে উল্লিখিত বিষয়গুলি মনোযোগ দিয়ে দেখি এবং সেখানে প্রকাশিত অঙ্গীকারসমূহকে পর্যালোচনা করি, তবে দেখা যাবে আধুনিক দৃষ্টিধারায় স্নাত একটি দূরদর্শী পরিকল্পনা যা বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের মানুষকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেয়। সুশাসন (নির্বাচন, গণমাধ্যম, তথ্যপ্রবাহ, জবাবদিহিমূলক স্মার্ট প্রশাসন, জনবান্ধব ও শৃঙ্খল বাহিনী, দুর্নীতির জিরো-টলারেন্স, স্থানীয় সরকার ও ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা), অর্থনীতি (টেকসই উন্নয়, গ্রামে শহরের সুবিধা আনয়ন, কৃষি-শিল্প-জ্বালানিতে স্মার্ট উন্নয়ন, যোগাযোগ ও সুনীল অর্থনীতি, এসডিজি, বদ্বীপ পরিকল্পনা), সামাজিক নিরাপত্তা (সর্বজনীন পেনশন, শিক্ষা, ক্রীড়া, বিবিধ জনকল্যাণ, জলবায়ু পরিবর্তন), পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ইত্যাদি সকল খাতেই অত্যন্ত প্রযুক্তি-নির্ভর অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি’ এবং তদনুযায়ী একটি বিশদ এবং সময়াবদ্ধ ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কর্মপরিকল্পনা ২০১১’ প্রণয়ন করে। এই কর্মপরিকল্পনাটিতে ১৫টি উদ্দেশ্য, ১১টি কৌশলগত বিষয় এবং ২৪৬টি করণীয় বিষয় উল্লিখিত হয়। ফলে দলগতভাবে অন্তত বলা যায় এই রাজনৈতিক দলটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। প্রশাসনের সর্বত্র ডিজিটাল প্রযুক্তি সমন্বয়ের ফলে স্মার্ট সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে এই ইশতেহারেও সুদৃঢ় আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। ফলে সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগের ইশতেহারটি বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির একটি সুষম মিশ্রণ ঘটিয়েছে সরকারি ব্যবস্থাপনার প্রায় সর্বত্রই; এবং এটি কার্যকর করার সময়ে অংশীজনের ভাষ্য সুবিবেচনায় নিতে পারলে এই ইশতেহারের বাস্তবায়ন আগামী বছরগুলোতে তরুণদের সামনে খুলে দিতে পারে অমিত বাতায়ন।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।