সৈয়দ মো. সিয়াম

বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম যেমন জড়িয়ে আছে ঠিক তেমনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নামও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ মিশে আছে বাংলাদেশের মাটির সাথে, মানুষের সাথে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, আইয়ুব খানের এক দশকের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন, ’৬২ ও ’৬৪ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, ৬৬ এর ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৬ দফাভিত্তিক ’৭০—এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়।

একই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” খ্যাত কালজয়ী ভাষণ । পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

আওয়ামী লীগ শব্দের উৎপত্তি আওয়াম ও লীগ দুটো প্রতিশব্দ থেকে। আওয়াম শব্দের অর্থ সাধারণ মানুষ বা জনগণ আর লীগ অর্থ সঙ্ঘ বা দল। দুটো শব্দ এক করলে হয় জনগণের দল। আর এই জনগণকে সাথে নিয়েই পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি নবীন দেশকে পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। প্রথমভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয় ভাগে আর্থ সামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর দেন বঙ্গবন্ধু। এরই মধ্যে বাংলায় সোনার ফসল ফলতে শুরু করে। আর ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে। যে ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। এরপর দিন যায় বছর যায়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে, দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ঘাতকেরা মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তা ভুল প্রমাণিত করে দলকে নতুন জীবন দান করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েকভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁর ধী-শক্তি, দৃঢ়তা, লক্ষ্য স্থিরে বিচক্ষণতা, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা আওয়ামী লীগকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে জনগণের সংগঠনের মৃত্যু নেই। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি মাইলফলক। নানা সংকটের পর, ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আবারও আসে জনগণের প্রিয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বিপুল ভোটে জয়ী হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি।

জনমানুষের দল আওয়ামী লীগের হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যেমন স্বাধীনতা এসেছে, ঠিক তেমনি জনগণকে সাথে নিয়েই তার যোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়েই বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। তার উদ্যোগের ফলেই অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। ২০০৮ থেকে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতায়। এরই মধ্যে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ অবস্থান করছে বাংলাদেশ। সব দেশি—বিদেশি ষড়যন্ত্র, চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে দেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এই সেতুর ফলে বদলে যাচ্ছে পুরো দেশের অর্থনৈতিক চিত্র পাশাপাশি এই সেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

সারাদেশে রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে যারমধ্যে বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে উল্লেখযোগ্য। ঢাকার আশপাশে নদ—নদী রক্ষা করে পরিবেশের সৌন্দর্য রক্ষায়ও চলছে নানাবিধ কর্মকাণ্ড। নিজেদের টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ সহজ ছিল না। কিন্তু তা করে বিশ্বকে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশ পারে, বাংলাদেশের মানুষ পারে। এরইমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। আমরা আজ এক নতুন বাংলাদেশকে দেখতে পাচ্ছি, নতুন স্বপ্ন বুনতে পারছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছেন। দিয়েছেন শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্লান। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আওয়ামী লীগের হাত ধরে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশের অভিমুখে ধাবমান।

আসন্ন ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার ঘোষণা করেছে তার মূল উপজীব্য বিষয় হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। যেটি অর্জনের সময়সীমা ২০৪১ সাল। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এবং এতে ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান’ হয়েছে দাবি করে সামনে কর্মসংস্থান বাড়ানোর স্লোগান তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় যে ইশতেহার দেয়া হয়েছিলো তাতে শ্লোগান ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’, যাতে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়টিকে বিশেষ অঙ্গীকারের তালিকায় রাখা হয়েছিলো যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এবার বিশেষ অগ্রাধিকারের শুরুতেই রাখা হয়েছে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথা, রাখা হয়েছে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করার মতো বিষয়টি। যা জনগণের চাওয়া পাওয়ার অন্যতম প্রধান একটি উপজীব্য বিষয়।

জনগণের দল আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়েই তাদের চাহিদা পূরণকে প্রাধান্য দিয়েই কাজ করতেই অঙ্গীকারাবদ্ধ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইশতেহার প্রকাশকালে দেশের ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন, “সরকার পরিচালনার বিশাল কর্মযজ্ঞে আমাদের কিছু ত্রুটি—বিচ্যুতি হওয়া স্বাভাবিক। আপনাদের রায় নিয়ে তা সংশোধন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাই”। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথরেখায় ইতিবাচক ধারায় আরও বলিষ্ঠ ও বেগবান করার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুবাতাস ছড়িয়ে দিতে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর। এটাই তো হচ্ছে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নেত্রীর সহজ সরল স্বীকারোক্তি।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে মানুষ আর বিভিন্ন গুজবেও কান দেয় না। তারা নিজকে বুঝতে শিখেছে। এদেশের মানুষ এখন আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, দুর্নীতিবাজ, জঙ্গিবাদের মদদদাতাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চায় না। মানুষ আগুন সন্ত্রাসীদের ঘৃণা করে, তাদের ডাকা হরতাল অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচী এখন আর কেউ মানে না। যে কারণে সবাই অবাধেই ঘরেবাইরে চলাফেরা করছে। এভাবেই তাদের আন্দোলনের নামে ডাকা নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করছে।

মানুষ জানে দেশের চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে তা থেমে যাবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না আসলে। জনগণ তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই, জাতির বৃহৎ স্বার্থে ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে আবারও ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। আর জনগণ তাদের ভালোবাসার দলকে সমর্থন করে যাবে আগামীর দিনগুলোতে। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীদের দেশবিরোধী সব অপচেষ্টার জবাব দেবে সরকারের পাশে থেকে। তার প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাচ্ছি। জনগণকে সাথে নিয়েই ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ, জনগণের ভালোবাসায় টিকে থাকবে জনগণের দল।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।