বিপ্লব কুমার পাল
আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠন করলে দেশের প্রথম সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। পাশাপাশি চালু করা হবে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এ প্রতিশ্রুতি দেন দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্ট্রান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বুধবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তাতে মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল জিনিষপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ, কর্মসংস্থান এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন।
১৫ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার এমন নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছে যেখানে বিএনপি ভোটের মাঠে নেই। লড়াই মূলত হচ্ছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীর সঙ্গে ২৮টি দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে।
নির্বাচনী ইশতেহারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছে আওয়ামী লীগ। সেগুলোর মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষায় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ঘোষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৃহত্তম সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ঘোষণায় খুশি। সংখ্যালঘু কমিশন এবং সখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের প্রতিশ্রুতি পাঁচ বছর আগের ইস্তাহারেও ছিল। সেই দাবি পূরণে ঐক্য পরিষদ দীর্ঘ আন্দোলন করেছে। এবারের ইশতেহারে দলটি বলেছে, বিএনপি-জামায়াতের সময়ে হওয়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে এবং ওই সব ঘটনায় পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়লাভের পর থেকেই সনাতন ধর্মালম্বীদের উপর হামলা শুরু হয়, যা চলে পরবর্তী পাঁচ বছর। বাগেরহাট, বরিশাল, ভোলা, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ফেনী, গাজীপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ, নাটোর, পিরোজপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ জেলায় হিন্দুদের উপর পরিকল্পিত হামলা হয়। দ্বীপ জেলা ভোলায় প্রায় দুই মাস ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের উপর নির্যাতন চলে। এসবের অধিকাংশই পুলিশের নথিভুক্ত হয়নি। ভুক্তভুগীরা ভয়ে কোন অভিযোগ পর্যন্ত করেননি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ১৯৯৬, ২০০১ বা তার আগের প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পরের বছরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টা বেশি। শুধু ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর। ১৯৯৬ এর নির্বাচনের বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১৪টি, পরের বছরে ৫৫৪টি । ২০০১ সালে ধর্ষণের ঘটনা ৫৬৬টি হলেও পরের বছরে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১টিতে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৫৪৫টি, পরের বছরে এ সংখ্যা ছিল ৬৯০। ২০১৮ সালে নির্বাচনের বছরে ধর্ষণের ঘটনা ৫৫৬টি, পরের বছরে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭টিতে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করে। হাইকোর্ট এক আদেশে নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন। এক বছরের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল সরকারকে ৫ খণ্ডের ১ হাজার ১০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। প্রতিবেদনে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং নির্যাতন প্রতিরোধে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাইকোর্টে আরেকটি রিট দায়ের করলে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক প্রতিবেদন ২০২২ সালের ১ এপ্রিল গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
তদন্ত কমিশনের ওই প্রতিবেদনে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় ঢাকায় ২৭৬টি, চট্টগ্রামে ৪৯৭টি, সিলেটে ১৭টি, খুলনায় ৪৭৮টি, রাজশাহীতে ১৭০টি এবং বরিশালে সর্বাধিক ২ হাজার ২২৭টি ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯২টি হত্যা, ১৮৪টি ধর্ষণ-সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনারও উল্লেখ আছে। কিন্তু ওই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য করা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন অনেকে। প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনও করছে কয়েকটি সংগঠন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আড়াই লাখ মানুষের স্বাক্ষরসংবলিত স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১২ এপ্রিল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ১৯ ফেব্রুয়ারি এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে ১৭ জুলাই বৈঠক করেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ ও তার নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর ঐক্যমোর্চার নেতারা।
অনেকে বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে দেওয়া ইশতেহারে সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ৫ বছরে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। বারবার বিষয়টি সামনে এনে আওয়ামী লীগকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার কি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেয়া প্রতিশ্রুতি কিছুই বাস্তবায়ন করেনি? আসুন পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য দীর্ঘ ৬০ বছরের সমস্যা মিটিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে দেড় বিঘা জমি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি মালিকানা দেওয়ার ক্ষেত্রে হেবা আইনের নিয়মমাফিক নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে সম্পত্তি হস্তান্তর করার সমান সুযোগ দেওয়া হয়েছে। হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রি আইন; শত্রু সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করা হয়েছে। মন্দির সংস্কার, মন্দিরভিত্তিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করছে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট। খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট এবং সালের বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট একইভাবে কাজ করছে।
আগে সংসদে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন মাত্র দুজন। এখন সংসদে সদস্য ২৩ জন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ২০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৬ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ৪ জন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার। একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ১৯ জন সংসদ সদস্য ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার। এবার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চারজনই মনোনয়ন পেয়েছেন। আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে একজনের সংখ্যা এবার বেড়েছে। আগের চেয়ে প্রশাসনে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য কেউ ছিলেন না, এখন হচ্ছেন। বর্তমান সরকারের সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে প্রধান বিচারপতি হয়েছেন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য কেউ যদি আন্তরিকতার সঙ্গে কিছু করে থাকে, যেটি আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কর্তব্য পালন করাটাও জরুরি। এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমন্নত রাখার ভোট, দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার ভোট, নিজেদের সাফল্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার ভোট। এবারের নির্বাচন অগ্নিসন্ত্রাস-নাশকতা, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে ভোট। এজন্য আগামী ৭ জানুয়ারি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে। দলবেঁধে ভোট দিয়ে বিশ্বকে জানান দিতে হবে- লাল-সবুজের পতাকার দেশটি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসম্প্রদায়িকতার, এখানে সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।