পলাশ আহসান

নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এনিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে নানা আলোচনা ভালোচনা চলছে। সেই আলোচনায় অর্থনীতি সমাজনীতি রাজনীতি নিয়ে নানা বিষয় আছে, কিছু প্রশ্ন আছে, গত নির্বাচনের ইশতেহারের সঙ্গে কিছু তুলনামূলক বিশ্লেষণও আছে। নির্বাচনী ইশতেহার আর কিছু নয়, সোজা কথায় নির্বাচনে জয়ের জন্যে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। সাধারণত কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জয়ী হলে তার দলীয় দর্শন অনুযায়ী মানুষের জন্যে কী কী ভালো করবেন তার একটা তালিকা দেয়া হয় নির্বাচনী ইশতেহারে।

শুধু জাতীয় নির্বাচন কেন আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও আজকাল ইশতেহার দেন প্রার্থীরা। যে কারণে এটি এখন খুব প্রচলিত রাজনৈতিক আচরণ। অনুশীলনটা ভালই বলতে হবে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার খুব সাধারণ ঘটনা নয়। বিশেষ করে কোন বড় রাজনৈতিক দল, যাদের সরকারে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের জন্যে খুবই সাবধানী বিষয়। রীতিমত সমাজ এবং ভোটারের মনস্তত্ব গবেষণা করে ইশতেহার দিতে হয় তাদের। কারণ ইশতেহারে অলীক কিম্বা বাস্তবায়ন অযোগ্য কোন বিষয় থাকলে পরে সেটা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। বিষয়টি যেহেতু কোটি মানুষের সমর্থন নেয়ার সঙ্গে জড়িত সেহেতু সংবেদনশীলও বটে।

এই লেখায় আমি আওয়ামী লীগের এবারে দেয়া ইশতেহারের মাত্র একটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো। ইশতেহারের কৃষি, দ্রব্যমূল্য, মানব সম্পদ উন্নয়নের মত প্রাত্যহিক জীবন ঘনিষ্ট অনেক বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয়ে আলো ফেলা খুব জরুরি বলে আমার মনে হচ্ছে। ইশতেহারের ২১ নম্বর পাতায় অঙ্গিকার বিষয়ক ছোট্ট একটি বিষয় আমার বিশেষভাবে আমার মনোযোগে কেড়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে “শিক্ষিত, দক্ষ, চৌকশ এবং দুর্নীতিমুক্ত মানুষদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্যে আগ্রহী করে তোলা হবে।”

অন্য নানা বিষয়ের পাতার পর পাতা ব্যাখ্যা থাকলেও ইশতেহারে এক্ষেত্রে লাইন কিন্তু একটাই। প্রথমত নতুনত্বের কারণে লাইনটি আমার চোখে পড়ে। তার পর ভাবলাম আওয়ামী লীগের মত একটি বড় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত মানুষের অভাব? দক্ষ, চৌকশ এবং দুর্নীতিমুক্ত মানুষেরই বা অভাব কিসে? বিষয়টা বেশ ভাবায়। পেশাগত কারণে আমি জানি ইশতেহার প্রণয়ণ কমিটিতে কারা ছিলেন। কোন কিছু না ভেবে শুধু বাহবা নেয়ার জন্যে কোন লাইন যুক্ত করার মানুষ তারা নন। নিশ্চয়ই তাদের গবেষণায় নির্দেশ এসেছে এমন লাইন দেয়ার।

এরপরও যখন ভাবছি এমন একটি লাইন তারা কেন দিলেন? তখন নিজের ভেতর থেকে কিছু চিন্তা আসছে। মূল কারণের সঙ্গে আমার চিন্তা মিলবে কীনা জানি না। তবে  নিজের ব্যাখ্যায় আমি নিজে  সন্তুষ্টু। যে কারণে পাঠকের সঙ্গে সেই ভাবনা শেয়ার করতে বসলাম এই লেখায়। প্রথমত আমরা বলতে পারি আওয়ামী লীগ ক্রমশ বড় হচ্ছে। এখানে সব শ্রেণির মানুষ দরকার হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় শিক্ষিত মানুষও দরকার হতে পারে। আবার এরকম কথাও ব্যাখ্যাও আসতে পারে যে, আসলেই দলে বেশি বেশি দরকার শিক্ষিত দক্ষ চৌকশ এবং দুর্নীতিমুক্ত মানুষ। কারণ একজন মানুষ শিক্ষিত হলে দক্ষ হতে পারেন হয়তো কিন্তু দুর্নিতীমুক্ত নাও হতে পারেন । যে কারণে এই সব গুণের সমন্বয় আছে এমন গুণী মানুষ দলে আনতে চাইছে আওয়ামী লীগ। এজন্যে তারা এমন ঘোষণা দিতেই পারে।

কিন্তু ব্যাখ্যাটা যদি এরকম হয় যে, দলীয় গবেষণায় এসেছে, দলে শিক্ষিত গুণী মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অথবা গুণী মানুষেরা রাজনীতিতে আসছেন না। তখন আলোচনার নিশ্চয়ই  নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ রাজনীতি করাটা এখন আমাদের দেশে একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের হোটেলে অথবা যাত্রীবাহী বাসে লেখা থাকে “এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ” বহু কলেজ কর্তৃপক্ষ আছে যারা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারলে মনে করে একটা কাজ করা হলো। বহু অভিভাবক আছেন যারা ছেলে মেয়েকে ওই রাজনীতিমুক্ত কলেজে পড়াতে পছন্দ করেন। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্র রাজনীতির চর্চা নিষিদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ করা একটা জাতির এরকম রাজনীতি বিমুখ হওয়ার বিষয়টি আমরা সবাই জানি। কিন্তু বলি না। আমার মনে হলো আওয়ামী লীগ এবার ইশতেহারে সত্য প্রকাশের সাহস দেখালো। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললো রাজনীতিতে আসুন। এখন দেশে রাজনীতি করার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কেন ঘোষণা দিয়ে রাজনীতির ভালো মানুষ খোঁজার মত পরিস্থিতি তৈরি হলো, সে প্রসঙ্গেও একটু কথা বলে নেয়া দরকার।

আমাদের শুরু করতে হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর্ জেনারেল জিয়ার শাসন শুরুর সময় থেকে। সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চা ওই দিন থেকে হোঁচট খেতে শুরু করলো, যেদিন তিনি বললেন “আই উইল মেকস পলিট্রিক্স ফর দ্যা পলিটিশিয়ানস” তার আরেকটা না বলা কথা ছিল। যেটা তিনি পরবর্তি সময়ে চর্চা করেছিলেন। সেটা হচ্ছে আই উইল মেক পলিট্রিক্স ইজিয়ার ফর দ্যা নন পলিটিশিয়ানস। এই অনুশীলনে রাজনীতিতে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চক্র, দালাল শ্রেণি এবং একদল অসৎ ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদের রা্জনীতি শেষ হয়ে গিয়েছিল। দেশপ্রেম বলে আসলে তাদের কিছু ছিল না। থাকার কথাও না। কারণ একজন রাজাকারের কাছে দেশপ্রেম আশা করে কো লাভ নেই। 

এই এরাই দুই সামরিক শাসকের ১৩ বছর ধরে দৌড়ে বেড়ালো। এদের হাতে জমলো কালো টাকা। আর সেই টাকা রক্ষায় তৈরি হলো ম্যাসলম্যান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া একটা ছেলে যখন এলাকায় রাজনীতি করতে গেলো, সে ওই কালো টাকা ও ম্যাসলম্যানের মুখে পড়লো। তাদেরকেও টিকতে হলো রাজনীতিতে। তৈরি হলো আমাদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পথ। এই পথে রাজনীতি চর্চা হলো এবং মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিল রাজনীতি থেকে। অথচ সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চাই একটি জাতির যেকোন উন্নয়ন টেকসই হওয়ার চাবি।

এখন আমরা ধরে নিতে পারি, আমাদের চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে বেশি বেশি সৎ ও যোগ্য রাজনীতিকের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে আওয়ামী লীগ। কোন সন্দেহ নেই এটা সাহসী ইশতেহার এবং সাধারণ মানুষের জন্যে ভাল খবর। যেকোন সাধারণ মানুষ একে স্বাগত জানাতে পারে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত, এই ইশতেহার বাস্তবায়নে খুব সাধারণ একটি চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা হচ্ছে সৎ ও যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া। মনে রাখা দরকার, প্রকৃত যোগ্য মানুষ কখনও আমি যোগ্য আমি যোগ্য বলে চিৎকার করে না। উল্টো করে যদি বলি, বলতে হয়, অযোগ্য মানুষেরই যোগ্যতার প্রচার দরকার হয়। যেটা আমাদের চারপাশে সবচেয়ে বেশি হয়। যাইহোক আপাত দৃষ্টিতে ইশতেহারে যোগ্য মানুষ খোঁজাটা খুব কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় আগামী দিনে আমাদের সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার পথে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী