ড. মো: আব্দুস সামাদ

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ ধারায় বলা আছে, কোন রাজনৈতিক দল যদি পরপর দুটি সংসদ নির্বাচনে যোগ না দেয় তাহলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হবে। বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে অনড় থেকেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসে। ওই নির্বাচনে যোগ না দিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিলের একটি আশঙ্কা তৈরি হত।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট নামের নির্বাচনী জোট সেবার আটটি আসনে জেতে। ওই নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে সামনে এনে ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনী জোট গঠন করে দলটি। ২০২৩-এ এসে এখন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেও কোনো প্রতিরোধ করতে পারছে না।

সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে থাকবে আর এই নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করবে। সব পক্ষ (নির্বাচন কমিশন, এমনকি রাষ্ট্রপতিও আলোচনার জন্য ডেকেছেন) থেকেই বারবার আহ্বান করা হয়েছে বিএনপিকে নির্বাচনে যোগ দেয়ার জন্য, কিন্তু বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি।

বিএনপি তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে করে ক্রমাগত হরতাল ও অবরোধের মত কর্মসূচী দিয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু নির্বাচন বর্জনই করছে না, ২০১৪ সালের মত নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। প্রায় ১০ বছর আগে ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে দেশজুড়ে এমন ভয়াবহ সহিংসতা হয়েছিল যে, শুধুমাত্র নির্বাচনের দিন সহিংসতায়ই প্রিজাইডিং অফিসারসহ ২৬ জন প্রাণ হারায়।

গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ওই ঘটনায় পেট্রলবোমা ও হাতে বানানো বোমা হামলায় এবং অন্যান্য সহিংসতায় চার শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। সহিংসতার কারণে আর্থিক ক্ষতি ছিল দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি।

এবারও গত ২৮ অক্টোবর থেকে নিয়মিত যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বিএনপির পরিকল্পনা ছিল যে, ভোট গ্রহণের আগে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা যে পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন না হয়। এ লক্ষ্যেই বিএনপি ট্রেনে, বাসে আগুনসহ নানা রকম নাশকতামূলক কাণ্ড করে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে দরবার-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, বিএনপি এই লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে আর জনগণও এই সহিংস ঘটনা প্রত্যাখ্যান করেছে।

পুলিশের দাবি এই সব “নাশকতার” ঘটনার পেছনেই বিএনপির হাত আছে। এক  বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের পুলিশ লিখেছে, “তারা সাধারণ মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাদের কর্মসূচী বাস্তবায়নে নাশকতা ও হিংসাত্মক কার্যক্রম চালায়। তারা দেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর পৈশাচিক ও ঘৃণ্য কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।”

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও তার মিত্ররা ধারাবাহিকভাবে অবরোধ-হরতালের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি হরতাল-অবরোধে ঘটছে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসাবে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৮৭টি বাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে আর এসময়ে বিভিন্ন জেলায় গণপরিবহন ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান কম চলায় পরিবহন খাতে ক্ষতি হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সমিতির হিসাব অনুযায়ী ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ঢাকায় ২০ শতাংশ গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ৪২২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর একই সময়ে ঢাকার বাইরে ৬০ শতাংশ বাসে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকায় ক্ষতি হয় ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে গড়ে ৪০ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ থাকায় ছয় হাজার ২৫১ কোটি ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সব মিলে ঢাকাসহ সারা দেশে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ১৭ হাজার ১১৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ড্রাইভার, হেল্পারসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। সড়ক পরিবহনের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ-হরতালে রেলে অনেকগুলো নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।

সড়ক ও রেলে নাশকতার পাশাপাশি ভিন্নমাত্রার রাজনৈতিক অরাজকতা, সন্ত্রাস ও নাশকতা সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পলায়নরত পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা, হাসপাতালে ঢুকে ভাঙচুর এবং অ্যাম্বুল্যান্সসহ সব গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে আক্রমণ, ভাঙচুর, বাসভবনের ভেতরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা সাংবাদিকদের পিটিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়েছে এবং তাঁদের গাড়ি, মোটরবাইক ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রায় দুই মাস ধরে প্রতিদিনই অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাংবাদিকদের কাছে দলের কর্মসূচী জানিয়ে আসছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী। গোপন “নাশকতা”র অভিযোগ ছাড়া এসব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার মত দৃশ্যমান কোন তৎপরতা নেই দলটির। অবরোধ কার্যকর করার জন্য পুরো বিএনপি বা বিরোধীদের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনা। জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসাত্মক রাজনীতি জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।

নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়া সেটি যে কোনো রাজনৈতিক দলের অধিকার আছে। নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করতে পারে কিংবা নাও করতে পারে কিন্তু নির্বাচন প্রতিহত করার এখতিয়ার কারো নেই। নির্বাচন প্রতিহত করার কথা বলা মানে, দেশবিরোধী-গণতন্ত্রবিরোধী কথাবার্তা।

নির্বাচন বর্জন করে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিএনপির ১৫ বছর কেটেছে, আগামী কত বছর কাটবে কেউ জানেনা। কোনো একটি দল না আসলেও আরও দল আছে তারা তো অংশগ্রহণ করবে। বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন গুলোতেও আসেনি। কিন্তু সেখানে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল আর সেই নির্বাচনগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্যও হয়েছে।

বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যে, নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা না পেলে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে এমন চিন্তা একটি মারাত্মক ভুল। শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকার প্রয়োজনগুলো তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপি ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের মতোই ভুল করলো বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে দলটি বারবারই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ২০২০ সালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চট্টগ্রাম নগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এই সরকারের আমলে আগের দুই একটি নির্বাচন বর্জন সঠিক হয়নি। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি ‘ভুল’ করেছে- এমন মন্তব্য করেছিলেন প্রয়াত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেছেন, নির্বাচনে অংশ না নেয়া বিএনপির বড় ভুল। বিএনপি একটি বড় দল, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা তাদের বড় ভুল। তারা নির্বাচন করলে দেশে নেতা তৈরি হতো। নির্বাচন হলো জনগণের সাথে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক স্থাপনের পন্থা।

২০১৪ সালে নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি যে জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতির পথ ধরেছিল সেখানেই তাদের সাথে জনগণের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। তাদের এখনকার যে আন্দোলন তা কোনোভাবেই জনসম্পৃক্ত নয়, নিজেদের এজেন্ডা পূরণে জনগণকে হেনস্তা করা হচ্ছে। জ্বালাও পোড়াও হত্যাযজ্ঞকে কেউ আন্দোলন বলে দাবি করতে পারেনা ।

আন্দোলনের এই ধারার জন্য বাংলাদেশের মানুষ বিএনপিকে বর্জন করেছে। এবারের নির্বাচনে গিয়ে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগটা তারা নিতে পারতো। সেটা না করে আবারও জ্বালাও পোড়াও চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে এটা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এই নির্বাচনে না গেলে “ছত্রখান” হয়ে যেতে পারে।

নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিএনপি নির্বাচনে না এসে ও মানুষকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলে অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। বিএনপি নির্বাচনে না এসে চরম ভুল করছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো রাজনৈতিক দল যদি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা হারায়, সেই রাজনৈতিক দল আর টিকে থাকতে পারে না।

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই কোনো রাজনৈতিক দল এক দশকের মধ্যে দুটি নির্বাচন বয়কট করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এবারের নির্বাচন বয়কটও কি বিএনপির অস্তিত্ব সংকট সৃষ্টি করতে পারে? ইতিহাস ভবিষ্যৎবাণী করতে না পারলেও সেটাকে অনুধাবন করতে পারে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।