মো. হাসানুর রহমান (হাসান)

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর যুদ্ধবিধস্ত দেশ পুনর্গঠনে হাত দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জাতীয়করণ করা হয় ব্যাংকিং খাত। স্টেট ব্যাংক অব ইস্ট পাকিস্তান রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়।

জাতীয়করণের মাধ্যমে ১২টি ব্যাংক একীভূত করে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, পূবালী ও উত্তরা- এ ছয়টি সরকারি ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। এভাবে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের ব্যাংকিং কার্যক্রমের। বর্তমানে দেশে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি ব্যাংক, নয়টি বিদেশী ব্যাংক ও তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক এবং ৩৪টি দেশী-বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ, বিগত দেড় দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এদেশে। এই উন্নয়নে অবদান রাখার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হল ব্যাংকিং খাত। দেশের জনগণ এবং ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক ও আর্থিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের যে আস্থা ও নির্ভরতা রয়েছে এটাই তার বড় প্রমাণ।

ব্যাংক সাধারণত আমানতকারীদের সম্পদ জমা রাখে এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করে এবং এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আস্থার সঙ্গে একটি দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে থাকে। তাই ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা থাকাটা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি অটুট আস্থার একটি প্রাথমিক কারণ হল আর্থিক পরিষেবার সহজলভ্যতা।

অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক বা ব্যাংকিং সেবা প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকার মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখা, এটিএম, ডিজিটাল ওয়ালেট ইত্যাদি সেবা চালু করেছে এবং এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে স্বল্প বা বিনা খরচে আর্থিক তথা ব্যাংকিং সেবায় অন্তর্ভুক্ত করা।

এ সেবার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কৃষকদের জন্য মাত্র ১০ টাকায়, তৈরি পোশাক শ্রমিক বা স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার বিধান। এই অন্তর্ভুক্তি লক্ষ লক্ষ

 বাংলাদেশীকে ক্ষমতায়ন করেছে, তাদের সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং তাদের আর্থিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার সুযোগ দিয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অর্থনৈতিক ওঠানামা এবং বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।  এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, সেক্টরটি উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীলতা দেখিয়েছে। বিচক্ষণ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা এবং ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলির স্থিতিস্থাপকতা জনগণের মধ্যে আস্থা জাগিয়েছে, তাদের আশ্বস্ত করেছে যে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত।

ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির একীকরণ জনগণের আস্থাকে আরও দৃঢ় করেছে। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপস এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সলিউশনগুলি ব্যাংকিং পরিষেবাগুলিকে আরও সুবিধাজনক এবং দক্ষ করে তুলেছে। সর্বোচ্চ দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক কৌশলগত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রম অটোমেশনের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিগত দশ বছরে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে এবং প্রকল্পের সবচেয়ে বড় খাত অটোমেশন এর আওতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পূর্ণ পেপারলেস ব্যাংকিং ব্যবস্থায় রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সমৃদ্ধ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো অনলাইন ব্যাংকিং, বাংলাদেশ অটোমেটেড চেক প্রসেসিং সিস্টেম (BACPS), বাংলাদেশ ইলেক্ট্রনিক ফান্ডস্ ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (BEFTN),  RTGS (Real Time Gross Settlement), ই-কমার্স ও এম-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা, অনলাইন পেমেন্ট, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং সেবা, ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ, বাংলাদেশ (এনপিএসিবি) ও ইলেকট্রনিক ড্যাশবোর্ড চালুকরণ।

স্বচ্ছতা এবং নৈতিক আচরণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কঠোর প্রবিধান এবং তদারকি নিশ্চিত করে যে ব্যাংকগুলি সততার সাথে কাজ করে।  নৈতিক অনুশীলনের প্রতি এই প্রতিশ্রুতি মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে। 

তারা সিস্টেমের ন্যায্যতায় বিশ্বাস করে, যা তাদের বিনিয়োগ করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যে বিষয় গুলো উল্লেখযোগ্য তা হলো-

১. ব্যাংকিং কার্যক্রমকে সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তিনির্ভর করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রূপান্তর করা;

২. ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করা;

৩. যোগ্য ও পেশাদার ব্যাংকারদের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেওয়া

এবং ৪. খেলাপি ঋণের সন্তোষজনক সুরাহা করা। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ চারটি বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে ব্যাংকিং খাতে দেশের মানুষের আস্থা ধরে রেখেছেন।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো শুধু মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান নয়;  তারা সক্রিয়ভাবে সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত এবং সামাজিক কারণগুলিতে অবদান রাখে।  বিভিন্ন কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার উদ্যোগের মাধ্যমে, ব্যাংকগুলি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশগত টেকসই প্রকল্পগুলিকে সমর্থন করে। 

সম্প্রদায়ের উন্নয়নে এই সম্পৃক্ততা ব্যাংকিং সেক্টরের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলে, আর্থিক লেনদেনের বাইরে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে। এছাড়াও আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা ভোগ করে থাকে। এখানে ব্যাংক বন্ধের ব্যাপারে সরকার সব সময়ই একটি সামাজিক চাপে থাকে।

কোনো ব্যাংক বন্ধের উপক্রম হলে দেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিধায় সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে সরকারকে এগিয়ে এসে সেই ব্যাংককে রক্ষা করতে হয়। এ কারণে শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নয়নশীল অনেক দেশেই ব্যাংক সহসা বন্ধ হতে দেখা যায় না।

সরকারের এই সামাজিক একই সাথে অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতার কারণেও আমাদের দেশের ব্যাংক বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই এবং এই একই কারণে ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থ ফেরত না পাওয়ার কোনো শঙ্কাও থাকা ঠিক নয়।

ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা নিছক আর্থিক স্থিতিশীলতার ফলে নয়;  এটি অ্যাক্সেসযোগ্য পরিষেবা, উদ্ভাবনী সমাধান, নৈতিক অনুশীলন এবং সক্রিয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার চূড়ান্ত পরিণতি। বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ যেখানে ব্যাংকিং খাত ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে এবং জনগণের পরিবর্তিত চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে চলেছে।

বর্তমান সরকারের নানাবিধ প্রচেষ্টা ব্যাংকিং খাতকে বিকশিত করতে সহযোগিতা  করছে, এবং  ব্যাংকিং স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রয়াসে ব্যাংকিং খাতের পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। 

লেখক: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইউনিভার্সিটি, জামালপুর।