বিশ্বজিৎ দত্ত

নির্বাচনের গরমে আরসি(RC) খান আরামে।  আরসি(RC) মূলত একটা কোমল পানীয়। নির্বাচনের সময় তারা একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এইরকম একটা বিজ্ঞাপন টেলিভিশনে প্রচার হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রাস্তায় নামলেই তখন বাচ্চারা এই গান গেয়ে উঠতো, এমনকি কেউ আরসি(RC) কোলা খেলেই সবাই একরাশ হাসি দিয়ে বলতো, কী নির্বাচনের গরমে আরসি(RC) খাচ্ছেন আরামে?

নির্বাচন আসলেই নির্বাচনকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন, প্রচার, প্রসার চলতেই থাকে। এই সময় প্রার্থীরা নিজেদের প্রচারে সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয় করেন। দুদক এই বিষয়ে আবার ফোঁড়ন কেটেছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনের ব্যয়কৃত অর্থ যেন অবৈধ বা কালো অর্থ না হয়।

যদিও কোন কোন প্রার্থী কালো অর্থ বা অবৈধ অর্থ নির্বাচনী প্রচারে ব্যয় করছেন সেই তালিকা বা নাম দুদক প্রকাশ করেনি কখনো। শুধু ফ্যাক্টই জেনেছি আমরা, উদাহরণ আর জানতে পারিনি বা সুযোগ মেলেনি।

নির্বাচনের প্রচার-প্রসার বা বিজ্ঞাপনের কথা এসেছে মূলত বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের হাওয়া বইছে। ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে সুষ্ঠু ভোট হবে এটা সবারই আশা, বিএনপি বা জামায়াত ছাড়া। কারণ তারা নির্বাচনের অংশও নেয়নি, তাদের প্রার্থিতা নিয়ে কোনো লড়াই করার আর সুযোগ তাদের নেই। তাই বাইরে থেকে তারা যত ফাঁকা গুলি ছাড়া যায় তা করছে। কখনো কখনো আবার দেশের বাইরে থেকে কিছু লোক বা গোষ্ঠী লবিস্ট হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছে তারা, যেন নির্বাচন নিয়ে অনেক বেশি অসত্য, অর্ধসত্য, মিথ্যা, গুজব, ভুলতথ্য, অপতথ্য প্রচার করা যায়।

গবেষণা বলছে,  যুদ্ধ, সংঘাত, নির্বাচন, অতিমারি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় মিথ্যা (Lies), গুজব (Rumours), ভুলতথ্য (Misinformation), অপতথ্য (Disinformation), অর্ধসত্য (Half-truth), প্রচারণাভিত্তিক (Propaganda) তথ্য বেশ দ্রুত ছড়ায়।

তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন অসত্য, অর্ধসত্য, মিথ্যা, গুজব, ভুলতথ্য, অপতথ্য প্রচারিত হচ্ছে। এটা কি শুধু বাংলাদেশে তা নয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অসত্য, অর্ধসত্য, মিথ্যা, গুজব, ভুলতথ্য, অপতথ্য প্রচার করা হয়েছিল ২০১৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন এবং বিশ্লেষকেরা প্রমাণ করেছেন তার সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত অসত্য, অর্ধসত্য, মিথ্যা, গুজব, ভুলতথ্য, অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে তা ভোটারদের মনে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।

শুধু কি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও একই পথে হেঁটেছেন ফ্রাঁসোয়া ওলাদ। তিনি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর স্ত্রী বিজিত ম্যাক্রোঁর সাথে তার বয়সের দূরত্ব নিয়ে বেশ জমানো গুজব প্রচার করেছিলেন। আরও আছে। ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নির্বাচনের অর্থ সহযোগিতা দিচ্ছে সৌদির এক প্রতিষ্ঠান তাও প্রচার করা হয়। সবকিছু দূরে ঠেলে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ কিন্তু ঠিকই জয়ী হতে পেরেছেন।

ফিরি বিএনপি বা জামায়াতের প্রসঙ্গে।  ৩০ জানুয়ারি ২০১৩, খালেদা জিয়া ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় ‘ZIA: The thankless role in saving democracy in Bangladesh’ শীর্ষক একটি কলাম লেখেন এবং সেইখানে পরিষ্কারভাবে তিনি পশ্চিমাদের আহ্বান জানান যে, বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় যাওয়া ভ্রমণকারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসহ অনেক বিষয়। একইভাবে তিনি বাংলাদেশে তৎকালীন চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হতে থাকা অভিযুক্তদের বিচারের তীব্র সমালোচনাও করেন।

এই হচ্ছে শুরু, এরপর বিএনপি বা জামায়াত একের পর এক চাল দিয়েছে। সব যে ঠিকভাবে কাজ করেছে এমন নয়, কিন্তু সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিং-এ প্রতি সেশনে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করার জন্য কয়েকজন সাংবাদিক তো আছেনই। তারা দেশের ছোটখাটো বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করেন বা প্রশ্ন করেন, যা আসলে দেশের গণমাধ্যমগুলো ঠিকভাবে নজর দেয় না।

‘ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে কোন দলের ব্যয় কত: ডিআরএলের গবেষণা’ এই শিরোনামে ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন বলছে, নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রচার-প্রসার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের গবেষণায় উল্লেখ করা মেটার তথ্যে দেখা যায়, নিজেদের সরাসরি রাজনৈতিক শ্রেণিতে রেখে বিজ্ঞাপন দেওয়া শীর্ষ ১০ পেজের মধ্যে রয়েছে বিএনপি মিডিয়া সেল ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)। এই দুটি পেজ থেকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ডলারের বিজ্ঞাপন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮ লাখ টাকার সমান।

প্রশ্ন হলো, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেই, জামায়াতও নেই। তাহলে তাদের এত এত বিজ্ঞাপন কীসের? প্রতিবেদন বলছে, আওয়ামী লীগ নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খানও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এখন সময় বদলে গেছে। প্রচারের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটাকে আওয়ামী লীগ ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, সাধারণ প্রচারে মাইক ভাড়া করতে যেমন অর্থ ব্যয় হয়, তেমনি ফেসবুকে বার্তা বেশি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে কিছু অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটা স্বাভাবিক বিষয়। 

যদি তাই হয়, তাহলে বিএনপি ১৬ হাজার ডলারের বিজ্ঞাপন দিয়ে কী প্রচার করছে? যদি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো তাহলে বোঝা যেত যে, তাদের প্রচারণায় তারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। তারা তো নির্বাচনে নেই তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রচার বা বিজ্ঞাপন কীসের?

তাদের প্রচার বা বিজ্ঞাপন হলো, অসত্য, অর্ধসত্য, মিথ্যা, গুজব, ভুলতথ্য, অপতথ্য। এইসব তারা প্রচার করে জনগণদের যেমন বিভ্রান্ত করছে, তেমনি নির্বাচনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এটা কি উচিত? একে তো তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না অপরদিকে তারা অসত্য, অর্ধসত্য, মিথ্যা, গুজব, ভুলতথ্য, অপতথ্য প্রচারে দেশের অর্থ ব্যয় করছে। এতেই কি প্রমাণিত হয় না বিএনপি আসলে দেশের ভালো চায় না, জনগণের ভালো চায় না। তারা চায় নিজেদের স্বার্থে দেশের জনগণ মাঠে নামুক। এটা কি হয়?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।