নিজস্ব প্রতিবেদক

“আজকে যখন ট্রেনের ভেতরে মায়ের কোলে শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায়,তখন আমাদের বলতে হয় এই ঘটনা রাজনীতির ফসল হতে পারে না। এটা অন্য কিছু, এই অন্য কিছু স্বাধীন বাংলাদেশে আর দেখতে চাই না। আমাদের এখন নাশকতাকে না বলতে হবে,”  গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলা নাশকতার বিরুদ্ধে এই ভাষায় ক্ষোভ আর আক্ষেপ এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে।

বিএনপি ও সমমনাদের  রাজনৈতিক আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে, বাস-ট্রেনে আগুনের ঘটনায় প্রাণহানি এবং নানা ধরনের নাশকতার প্রতিবাদে রাজধানীতে প্রতীকী পদযাত্রা করেছেন বিভিন্ন  শ্রেণি-পেশার মানুষ।

ওই আয়োজনে অংশ নিতে ভুক্তভোগীদের পরিবার, শিক্ষক-ছাত্র, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা থেকে বিনোদন জগতের তারাকাদের অনেকই শামিল হন। সেখান থেকে যেকোনো মূল্যে নাশকতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এছাড়া নাশকতাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এসে বিচার দাবিও করেছেন অংশগ্রহণকারীরা।

শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘আমরাই বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে এ পদযাত্রার আয়োজন করা হয়।

পদযাত্রা শুরুর আগে সেখানে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের উদ্যোগে ‘নির্দেশনা’ নামে একটি পথনাটক পরিবেশন করা হয়।

এরপর বেলা সাড়ে ১১ টায় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে শহীদ মিনার থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রাটি দোয়েল চত্বর, মৎস ভবন ঘুরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট হয়ে শাহবাগ গিয়ে শেষ হয়।

পদযাত্রায় সবাইকে কাঁদিয়ে বক্তব্য দেন সম্প্রতি ট্রেনে অগ্নিসন্ত্রাসে স্ত্রী সন্তান হারানো মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি জাতির কাছে বিচার দিতে এসেছি। যারা আমার স্ত্রী সন্তানকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে তাদের যেনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়। আমি স্ত্রী সন্তান হারিয়েছি। আমাকে লাশ বহন করে নিয়ে যেতে হয়েছে। যে সন্তানকে সুন্দর করে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। তাকে আর কোলে নিতে পারি নাই। লাশ কোলে নিয়ে বাড়িতে যেতে হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বিচার দাবি করি।’

অগ্নিসন্ত্রাসের হুকুমদাতাদের বিচার দাবি করে ২০১৩ সালে শাহবাগে বাসে আগুন দেয়ার ঘটনায় হাত ঝলসে যাওয়া ভুক্তভোগী খোদজা নাসরীন বলেন, ‘আমি ২০১৩ সালের ২৮নভেম্বর আমার কর্মস্থল থেকে যখন শাহবাগ এসে পৌঁছায় তখন আমরা সকল যাত্রী চিৎকার করছিলাম। আমার দুটি হাত ঝলসে গেছে। তারপর আমার এই দুই হাতে অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগেছি। এই অগ্নিসন্ত্রাসের হুকুমদাতাদের বিচার করতে হবে।’

পদযাত্রা শুরুর আগে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিহত নাহিদের মা রহিমা বেগম বলেন, ‘আমরা ছেলে বাসায় আসার পথে বাসে আগুন দেয়,সেখানে আমার ছেলে মারা যায়। কেনো এই অগ্নিসন্ত্রাস? এই স্বাধীন দেশে কী আমাদের নিরাপদে পথ চলার অধিকার নাই? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’

নারী উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা শান্তি প্রিয় সাধারণ মানুষ। অগ্নিসন্ত্রাস সেই শান্তির বিরুদ্ধে। তাই আমরা প্রতিবাদ করতে একত্রিত হয়েছি। আর এই অগ্নিসন্ত্রাস, ভাংচুর আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্যে আরও বেশি ক্ষতিকর। আমাদের পণ্যের সাথে সাথে লোকবলেরও প্রাণহানি ঘটে৷ যার ফলে আমাদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়৷ আমরা শান্তি চাই।’

চিত্রনায়ক রিয়াজ বলেন, ‘এরকম বাংলাদেশ আমরা কেউ চাই না। আজকে যখন ট্রেনের ভেতর মায়ের কোলে শিশু আগুনে মারা যায়, তখন আমাদের বলতে হয় এ আসলে রাজনীতি নয়, এটা অন্য কিছু। এই অন্য কিছু স্বাধীন বাংলাদেশে আর দেখতে চাই না। যথেষ্ঠ হয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষ তাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে একটি পতাকা এনে দিয়েছেন। আর সেই বিজয়ের মাসেই যখন এরকম নাশকতা হয়, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। এই নাশকতা করে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত।’

চিত্রনায়িকা নিপুন আক্তার বলেন, ‘আমরা নাশকতা চাই না। আমরা আমাদের সন্তান, জানমালের সুরক্ষা চাই। কিছুদিন আগে রেলের মধ্যে এক মা তার সন্তানকে কোলে জড়িয়ে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। আমরা নাশকতা চাইনা।’

অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ নারী সমাজ ব্যানারে পদযাত্রায় অংশ নেয়া মারিয়া বেগম বলেন, ‘২০০৯সালের  পর থেকে দেশ শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলো উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়। সেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য ২০১৩ সাল থেকে একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করে। বারবার মানুষ পুড়িয়ে মেরে দেশকে অস্থিশীল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে তারা বাধাগ্রস্ত করতে আবারও সেই অগ্নিসন্ত্রাসের রূপ ধারণ করেছে। আমরা তাদের বিচার দাবি করছি।’

পদযাত্রা শেষে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশে প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আজকে আমরা সমস্ত শ্রেণি পেশার মানুষ এখানে একত্রিত হয়েছি, নাশকতাকে না বলার জন্য। আপনারা জানেন কীভাবে বাসে, ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। আপনারা দেখেছেন ট্রেনে আগুন দিয়ে শিশুসহ মাকে হত্যা করা হয়েছে। এটি কোনো রাজনীতি হতে পারে না। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। অগ্নিসন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’

সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বিএনপি-জামায়াত অপশক্তি, যারা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে, নির্বাচনের প্রস্তুতি ব্যর্থ হয়েছে। তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে অগ্নিসন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। তারা দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধা দিতে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের নাশকতার বিরুদ্ধে দেশের মানুষ। এদেশের মানুষ শান্তির পক্ষে, অগ্নিসন্ত্রাসের বিপক্ষে।’ মুুক্তিযুদ্ধ চেতনার বাংলায় নাশকতা থাকতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

পদযাত্রা শুরুর আগে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেড়ারোশন ‘নির্দেশনা’ নামে একটি পথনাটক পরিবেশন করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা -” ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি! ফাঁসি চাই!, আগুন সন্ত্রাসীর ফাঁসি চাই”, ”আগুন সন্ত্রাসের আস্তানা! ভেঙে দাও! গুড়িয়ে দাও!, আগুন সন্ত্রাসের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না! ইত্যাদি বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

আমরা বাংলাদেশ ব্যানারে পদযাত্রায় সংহতি জানিয়ে অংশগ্রহণ করে-”দেশের পক্ষে খেটে খাওয়া কৃষক সমাজ”,’ক্রীড়াসঙ্গ’, বাংলাদেশ এডুকেশন রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম, হিজড়াদের সংগঠন -হোপ এন্ড পিস ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, সুস্থ জীবন, পদ্ম কুঁড়ি হিজড়া সংঘ, সচেতন হিজড়া অধিকার যুব সংঘ, শান্তির নীড় হিজড়া সংঘ, নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন- আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নারী উদ্যোক্তারা, আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুব সমাজ, রিয়েল ফ্রেন্ডশিপ এ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় ইমাম সমাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, ব্যাংকার্স কমিউনিটি, ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নীলদল, অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ নারী সমাজ, নিপীড়নবিরোধী বুদ্ধিস্ট কমিউনিটি, সংহিতাবিরোধী ক্রীড়াবিদ ফোরাম, বাংলাদেশ ওলামা মশায়েখ ও সুশীল সমাজ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শিল্পীসমাজ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সঙ্গীত তারকা, নাটক ও চলচিত্র তারকা, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), স্বাধীনতা সাংবাদিক ফোরাম, খ্রিস্টান ও বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন, বিগ্রেড ৭১, শহীদ পরিবারের সন্তান ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, সোশ্যাল মিডিয়া ও টিকটক ইনফ্লুয়েন্সার, আইনজীবী, প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, টিএসসি ভিত্তিক সংগঠন, চারুশিল্পীসহ আরও অনেকে। এছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষও প্রতিবাদী পদযাত্রায় অংশ নেন।