কেউ ট্যাক্স দেবেন না। কোনো ইউটিলিটি বিল দেবেন না। কেউ আদালতে হাজিরা দিতে যাবেন না। সম্প্রতি এরকম আহবান জানিয়েছেন তারেক রহমান। আর আগে তিনি লন্ডন থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই অসহযোগের বাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি এইসব নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছিলেন। কেন জানি মনে হলো মনে হলো তিনি সরকার এবং রাষ্ট্র গুলিয়ে ফেলেছেন। কারণ সরকারে যে কেউ আসতে পারে। এর দর্শনের সঙ্গে সব মানুষের চিন্তার মিল নাও থাকতে পারে। সেই অমিলের কথা তিনি চিৎকার করে বলে বা লিখে বা অন্য যেকোন উপায়ে প্রতিবাদ করতে পারেন। কিন্তু জনগণকে সংবিধান বা রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করানোর মত কোন নির্দেশ কি তিনি দিতে পারেন?

এই প্রশ্ন এখন খুব শক্তভাবেই উঠছে। কারণ রাষ্ট্র এক এবং অদ্বিতীয় কাঠামো। রাষ্ট্র অখণ্ড। এনিয়ে কোন ভাগ নেই। এর বিরোধিতা করা যাবে না। এর ক্ষতি হয় এমন কিছু কোন কোন নাগরিক করতে পারবেন না। এমন কী রাষ্ট্রের অসম্মান হয় এমন কিছু বলাও যাবে না। কোনভাবে রাষ্ট্রের আনুগত্য থেকে সরা যাবে না। সরলে কী হবে সেটা আইনেই নানাভাবে বলা আছে। সেই ধারাবাহকতায় যদি কেউ ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমি আদালতে হাজিরা দেবো না, ট্যাক্স দেবো না কিম্বা বিদ্যুৎ ব্যবহার করবো কিন্তু বিলে দেবো না। এটা আসলে সরকারের বিরোধিতা হবে না। হবে রাষ্ট্রের ।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে তিনি যেকোনভাবে একটি প্রতিবাদ করতে পারেন। এমনকী দেশের সব মানুষকে তিনি তার পক্ষে থাকার আহবানও জানাতে পারেন। এখন সেটা জনগণ শুনবে কী শুনবে না সেটা জনগণের ওপর ছাড়তে হবে। প্রশ্ন ওঠে তখন, যখন এই অসহযোগের পদ্ধতি তিনি বাতলে দেন এবং সেই পদ্ধতির মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের ইঙ্গিত থাকে।

রাষ্ট্রদ্রোহের প্রসঙ্গ যখন উঠলোই তখন বলে রাখা ভাল এই দ্রোহ অনকে সময় নৈতিক হয়ে ওঠে। যেমনটা উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। প্রায় কাছাকাছি ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আইনের সূত্রে তিনিও কিন্তু তখন রাষ্ট্রদ্রোহী হয়েছিলেন। কিন্তু সেই দ্রোহ ছিল নৈতিকতার চেয়েও নৈতিক। কারণ তিনি তখন যে রাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন সেই রাষ্ট্র তিনি চাইছিলেন না। সেই রাষ্ট্র ভাগের চিন্তা বা স্বাধীনতার স্বপ্ন তাঁর মাথায় ততদিনে গেড়ে বসেছে। যে স্বপ্ন তিনি বুনে দিচ্ছিলেন ৭ কোটি বাঙালির মধ্যে।

এরও আগে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশদের থেকে ভাগ হওয়ার জন্যে একই রকম অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন । তিনিও ব্রিটেনের অংশ হয়ে থাকার বিষয়টি মানছিলেন না। তাই তার জন্যেও রাষ্ট্রদ্রোহী হতে নৈতিক কোন বাধা ছিল না। কারণ যে রাষ্ট্র তিনি মানেনই না সেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য তিনি কেন দেখাবেন? তিনিও ভারতের স্বাধীনতার কথা ভেবে ব্রিটিশদের তাড়াতে চাইছিলেন।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনের পর আরও দুই বার অসহযোগ আন্দোলনের প্রসঙ্গ এসেছে। তখন কোথাও ট্যাক্স না দেওয়ার আহবান কিম্বা আদালতে হাজিরা না দিতে যাওয়ার তখন প্রসঙ্গ আসেনি। কারণ সেই অসহযোগ ছিল সরকারের বিরুদ্ধে। সেগুলো ছিল অনেকটা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় না বসা বা ওই সময়ে সরকারের নির্দেশ না মানা কিংবা সরকারের নিয়মিত কার্যক্রমের প্রসঙ্গ। তাই সাংবিধানিক কোন নিয়ম ভাঙার প্রসঙ্গ সে সময় আসেনি।

গান্ধী বা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগে রাষ্ট্র ভাগের লক্ষ্য ছিল। তাদের অসহযোগে রাষ্ট্র ভাগের প্রসঙ্গ ছিল না। কারণ তখন বাংলাদেশ স্বাধীন। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার পরিচালনায় অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিল সেই অসহযোগ। এখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে তাহলে তারেকের এই অসহযোগে কী ভাগ করবে? তার লক্ষ্য কী মানুষের মতাদর্শ না রাষ্ট্র।

এতো গেলো সাংবিধানিক প্রসঙ্গ। যদি শুধু নৈতিকতার দিক দিয়ে ধরি তাহলে বলা যায়, আদালতে কতরকম অপরাধীর বিচার হয়। এর মধ্যে থাকে চোর গুন্ডা বদমাশ প্রতারক। এরা মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তোলে বলেই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসে। এখন গড়ে সব অপরাধীর পক্ষ নিয়ে তিনি কী বলতে পারেন যে আপনারা আদালেতে হাজিরা দেবেন না? মানুষ রাষ্ট্রককে খাজনা দেবে না? তাহলে রাষ্ট্র চলবে কী ভাবে? একটি অচল রাষ্ট্রই কী লক্ষ্য তারেক জিয়ার? মানুষ রাষ্ট্রের খরচে নেয়া গ্যাস বিদ্যুৎ ও পানি খরচ করবে কিন্তু বিল দেবে না? সেটা কী নৈতিক হলো?