প্রফেসর ড. মো: মনিরুল ইসলাম (সোহাগ)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নির্বাচনী আবহ। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মানুষের উৎসাহের অন্ত নেই। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ২৯টি রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলেই দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের তাণ্ডব শুরু হয়।
আসন্ন সংসদ নির্বাচন বাধা দিতে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে স্বাধীনতাবিরোধী এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিএনপি-জামায়াত। এবারও সেই ২০১৩ ও ১৪ সালের মতোই টানা হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীর ওপর হামলা এবং চলন্ত বাস-ট্রেনে অগ্নিসংযোগের দিকে ঝুঁকছে বিএনপি-জামায়াত।
২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত প্রায় ৪১৯ টি পৃথক ঘটনায় ১৫ জন পুলিশ সদস্যসহ হত্যা করে ৪৯২ জন নিরপরাধ মানুষকে। এ সকল অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে আহত হয় প্রায় আড়াই হাজারের মত মানুষ। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে বিএনপি-জামায়াত দেখায় তাদের ভয়ংকরতম রূপটিকে। এ সময় তারা আগুন ধরিয়ে দেয় সারাদেশের প্রায় ৫৮২ টি ভোটকেন্দ্রে, শত শত যানবাহনে, রাস্তার পার্শ্ববর্তী বৃক্ষরাজিতে, এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে।
নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় যেনে তারা পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে মারে বহু নিরপরাধ সাধারণ জনগণকে। অগ্নিদগ্ধ অসহায় মানুষদের কান্নার আহাজারিতে প্রকম্পিত হয়েছিল সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালগুলো। নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার সহ এই সন্ত্রাসী জোট হত্যা করে ২৬ জন মানুষকে। একবছর পর ২০১৫ সালের আবার মাথা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল আগুন সন্ত্রাসেরা।
সেসময় ২ হাজার ৯০৩টি বাস-ট্রাক, ১৮টি ট্রেন, ৮টি যাত্রীবাহী লঞ্চ, ৭টি ভূমি অফিসসহ ৭০টি সরকারি অফিসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে সন্ত্রাসী সংগঠনটি। এসব ঘটনায় নিহত হয় ২৩১ জন মানুষ এবং গুরুতর আহত হয় ১ হাজার ২০০ মানুষ। সেই অগ্নিসন্ত্রাসের বিভীষিকার কথা ভুলে যায়নি বাংলার জনগণ।
সেই সময়ে টেলিভিশনে দেখা একটি দৃশ্য আজও চোখে ভেসে উঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন বার্ন ইউনিটে অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার চিকিৎসাধীনদের দেখতে। তাঁর হাতটি ধরে কাঁদছিলেন এক নারী। তাঁর নাম গীতা সরকার। কাঁদতে কাঁদতে গীতা যে কথাগুলো বলছিলেন, সেগুলো মনে গেঁথে আছে। গীতা একজন গৃহবধূ, একজন স্ত্রী, একজন মা-সর্বোপরি এই সমাজেরই একজন মানুষ। গীতা বলছিলেন- ‘ওরা যে বোমাগুলো মারে বা যা-ই মারে, ওদের শনাক্ত করুন এবং যারা অর্ডার দেয়, তাদের পরিবারের লোককে ধরে ধরে আপনারা আগুনে পুড়িয়ে দেন। ওরা অর্ডার দিতে পারে, আমাদের তো রক্ষা করতে পারে না। আমাদের জন্য আপনারা সরকার। আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আমাদের রক্ষা করেন’। গীতা সরকারের সেদিনের সেই আকুতি কি দেশের ১৭ কোটি মানুষের আকুতি ছিল না?
অদ্যাবধি সেই অগ্নিসন্ত্রাসের কার্যক্রম চলমান। গত ১৩ই ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ উপেক্ষা করে নিজের গন্তব্যে যেতে ট্রেনে উঠেছিলেন সাধারণ যাত্রীরা। কিন্তু পথে অবরোধকারীরা গাজীপুরের ভাওয়ালে রেল লাইন কেটে ফেলায় এই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাতটি বগিসহ উল্টে পড়েছিল। এতে একজন নিহত ও কয়েক ডজন মানুষ আহত হন।
১৯ই ডিসেম্বর নেত্রকোনা থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ট্রেনে আগুন দেয়া হলে মা ও শিশু সন্তানসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ১৪ই ডিসেম্বর নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ৭২টি ক্লিপ খুলে ফেলে নাশকতার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রতিদিনই হরতাল-অবরোধের নামে চলছে বাস-ট্রেনে আগুন দেয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা। বিগত ২৮ অক্টোবর হতে অদ্যাবধি বিএনপি-জামায়াত জোট ৬৫০টিরও বেশি গণপরিবহনে অগিসংযোগের মাধ্যমে পুলিশ ও ঘুমন্ত শ্রমিককে হত্যা করেছে। আন্দোলনের নামে এসব কি ঘটছে এই স্বাধীন দেশে?
বিগত ২০১৩-১৪ সালে আন্দোলনের পর ব্যবসায়ী সংগঠনের করা এক জরিপে বলা হয়েছিল, একদিনের হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে গড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পোশাক খাতে ক্ষতি ৩৬০ কোটি টাকা। সরকারি রাজস্ব খাতে ১ দিনের ক্ষতি ২৫০ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা।
পাইকারি মার্কেট, শপিংমল ও অন্যান্য শপে ১ দিনের হরতাল-অবরোধে ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকা। আর্থিক ও ভ্রমণ খাতে ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা। যাতায়াত খাতে ক্ষতি ৬০ কোটি টাকা। উৎপাদন খাতে ১০০ কোটি ও আর অন্যান্য খাতে ১ দিনের ক্ষতি ৬৫ কোটি টাকা। বর্তমানে অর্থনীতির আকার ৪ গুণ বেড়েছে। ফলে এ সময়ের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ক্ষতিও সেই হারেই বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হরতাল-অবরোধে বহুমুখী ক্ষতি হচ্ছে। ১ দিনের অবরোধ-হরতালে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে প্রায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতির দায়ভার কি বিএনপি-জামায়াত নিবে?
রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়ার অধিকার যেকোনো রাজনৈতিক দলেরই আছে। কিন্তু মানুষের জান-মাল কেড়ে নেওয়ার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?
এদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন তো অতীতেও হয়েছে। হয়েছে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। কিন্তু সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো অগ্নিসন্ত্রাসের কর্মসূচি তো আগে দেখা যায়নি। যুগের পরিবর্তনের হাওয়া কেন রাজনীতিতে লাগবে না? রাজনীতি কেন এত দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেবে? এতে লোকসানটা কার? দেশেরই তো। এভাবে দেশের একটি প্রজন্মকে রাজনীতির প্রতি তো বটেই, রাজনীতিকদের প্রতিও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হচ্ছে। রাজনৈতিক অপশক্তি কি সামাজিকভাবেও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে? দেখা দিচ্ছে “সোশ্যাল ট্রমা”। এই দায়ভার কি বিএনপি-জামায়াতের না?
রাজনীতি তো জনগণকে নিয়ে। এখন জনগণ কাদের কথায় আস্থা রাখবে। বিএনপি-জামায়াত জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের কথা বলেছে। নিন্দুকেরা প্রশ্ন করতে পারেন, এত দিন বিএনপি-জামায়াত যে আন্দোলন করেছে, সেগুলো কি জনসম্পৃক্ত ছিল ? জনগণের আস্থা অর্জন না করলে আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করা যাবে না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলনের নামে যা হয়েছে, তাতে মানুষের মনে যে ‘আন্দোলন-ভীতি’ তৈরি হয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘সোশ্যাল ট্রমা’, সেটি দূর করতে না পারলে বিএনপির ‘আন্দোলন’ শুধু বিএনপিরই থাকবে। এতে জনগণের কোনো সম্পৃক্তি থাকবে না। জনগণের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করাটাই একটি রাজনৈতিক দলের বড় কথা। এই আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের সক্ষমতা কি বিএনপি-জামায়াতের আছে?
গনমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, চার-পাঁচজনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসে আগুন দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। আর একেকটি বাস পোড়ানোর জন্য প্রতিটি দলকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিচ্ছে দলটির হাইকমান্ড। অগ্নিসংযোগকারী বিএনপির কর্মীরা জনপ্রতি পাচ্ছে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। আর বাসে আগুন দিয়ে ভিডিও করে শীর্ষ নেতাদের পাঠালেই মিলছে এই টাকা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতা দখলের লোভে নাশকতা, অগ্নিসন্ত্রাসের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে দেশবাসীর ক্ষতি সাধন করছে। অন্যদিকে এই অর্থ যদি জনগণের উপকারে বা ভালো কোনো কাজে ব্যয় করতো তাহলে কিছু জনসমর্থন হয়তো জনগণ তাদের দিতো।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে প্রতিনিয়ত নির্মমতার যে চিত্র বর্তমানে ফুটে উঠেছে, তা একাত্তরের বর্বরতাকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। মানবতাবিরোধী এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে বহু মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। নিরীহ গবাদিপশু, গাছ-পালা, রাস্তা-ঘাট, যানবাহন কোনো কিছুই এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। অসংখ্য মানুষ এখনও অগ্নিসন্ত্রাসের ক্ষত বহন করে চলছে। পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে। অনেক নিষ্পাপ শিশু এতিম হচ্ছে।
ধারণা করা যায়, রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ বিএনপি-জামায়াত দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নস্যাৎ করার জন্য ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল, স্মার্ট, টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ, স্যাটেলাইট, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টেকসই উন্নয়ন, রূপকল্প-২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান-২১০০, ইত্যাদি ইতিবাচক শব্দগুলো বাংলার অভিধানে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে গণপ্রত্যাখিত বিএনপি-জামায়াত চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে বাংলার মানুষকে প্রতিনিয়ত পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ নামক শব্দের।
যত বাঁধাই আসুক, উন্নয়নের এই জয়যাত্রা থেমে যাওয়ার নয়। এদেশের সাধারণ মানুষ এখন এগিয়ে যাওয়ার পথে, তারা শুধু স্বপ্ন দেখে উন্নত এক ভবিষ্যতের। এই পথে দেশের জনগণ কখনো মেনে নেয়নি এবং মেনে নেবেও না এই মানবাধিকার বিরোধী ও বর্বর অগ্নিসন্ত্রাসীদের।
লেখক: প্রক্টর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।