মোহাম্মদ নাসির হুসেইন
যুক্তরাষ্ট্রের পর যুক্তরাজ্য ও কানাডার স্যাংশন তালিকায় বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪৬ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। একই ইস্যুতে কানাডা সরকার সাত ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে এই দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বাংলাদেশের কোনো নাম নেই। বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রায়শই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওঠানামার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই জটিল পরিক্রমায়, সম্প্রতি যুক্তরাজ্য এবং কানাডা যৌথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নেই। যেটা দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির জন্য নতুন সম্ভাবনার নানা পথ খুলে দিয়েছে।
এই অকল্পনীয় উন্নয়ন শুধু আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির প্রতি বাংলাদেশের আনুগত্যের ওপরই জোর দেয় না বরং একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্যও ভালো সূচনা করে। নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম যুক্ত না হওয়ার তাৎপর্য বোঝার জন্য, বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করা অপরিহার্য। নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রায়শই কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে নিযুক্ত, অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার এবং দেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার সম্ভাবনা বহন করে। এরআগে যুক্তরাষ্ট্র ১৩টি দেশের ৩৭জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দেয়। সেই তালিকায়ও কোনো বাংলাদেশির নাম ছিল না। মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সমন্বিত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এসব ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য ও কানাডা।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাপকাঠিতে যুক্তরাজ্য বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং গত দুই দশকে বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশে রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, যা উৎপাদন ভিত্তি উন্নয়নে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। দেশটি বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তহীন রফতানি বাজারও বটে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা ধীরে ধীরে আরো বাড়ছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে আগামী ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধাও ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্য। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬.৪ বিলিয়ন ডলার। দুই দেশ ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য থেকে ৫৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে, যা ২০২২ সালে কোনো দেশ থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ এফডিআই।
ইউরোপের মধ্যে জার্মানির পরই যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতের বড় ক্রেতা। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যের বাজারে পোশাক রপ্তানি করে আসছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যে ৫.৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। যার মধ্যে ৯০% এসেছে পোশাক শিল্প থেকে। তবে এটি আরও বৃদ্ধি পাবার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য থেকে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার সময় লন্ডনে অবস্থান করেন। ওই সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠক থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের শুভ সূচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার লন্ডন সফর করেছেন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা সই করেছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে কানাডার সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বসূলভ যার গভীরতা বিগত বছরগুলোতে আরো বেড়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠালাভের সময় থেকে এই রাজনৈতিক সম্পর্কের যাত্রা শুরু। মুক্তিযুদ্ধের সময় কানাডা সরকার, জনগণ এবং মিডিয়া বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল। কানাডা সেই সকল দেশের মধ্যে একটি যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পরেই ১৯৭২ সালে মে মাসে বাংলাদেশ কানাডায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে, এবং কানাডা বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয় ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে ধীরে ধীরে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। এই পারস্পরিক সম্পর্ক কমনওয়েলথ এবং নানাবিধ ইউএন কর্মকাণ্ডে বরাবরের মতই সহযোগিতামূলক ছিল।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাপকাঠিতে কানাডা বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ইপিবি (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো) তথ্য অনুযায়ী, ১১তম বৃহত্তম রপ্তানিকারক অংশীদার হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কানাডাতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া এটি উত্তর আমেরিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম প্রধান বাজার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কানাডায় বাংলাদেশের রপ্তানি পোশাকের পরিমাণ ১.৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের অর্থবছরে ১.৩৩ বিলিয়ন ছিল, যা ১৬.৫৫% বৃদ্ধি দেখায়।
অর্থনৈতিক প্রভাব: নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পাওয়ার অর্থনৈতিক প্রভাব বহুবিধ। প্রথমত, এই ছাড় বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করে, দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগের জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ প্রদান করে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা, যারা নিষেধাজ্ঞার তালিকাগুলো সতর্কতার সাথে যাচাই করে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নকে উৎসাহিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী অর্থনীতির জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠেছে। নিষেধাজ্ঞার অনুপস্থিতি মসৃণ বাণিজ্য সম্পর্ককে সহজতর করে এবং পণ্য ও পরিসেবার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করে, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সংহত করে।
কূটনৈতিক দূরদর্শিতা: নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে বাংলাদেশের বাদ পড়া দেশটির কূটনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতি অঙ্গীকারের নিদর্শন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করে এমন জটিলতা এড়িয়ে, জাতি সংলাপ এবং সহযোগিতার মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির উপর জোর দেয়। এটি শুধু বৈশ্বিক মঞ্চে তাদের অবস্থানই বাড়ায় না, আন্তর্জাতিক সদিচ্ছা বৃদ্ধি করে সহযোগিতামূলক উদ্যোগের জন্য বাংলাদেশক একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা: আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে বাংলাদেশের বাদ পড়া একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে, দ্বন্দ্বের বিষয়ে কূটনৈতিক সমাধানের প্রতি জাতির প্রতিশ্রুতি একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা সমগ্র অঞ্চলের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।
বিএনপি ও জামায়াত-পন্থীরা প্রচারণা চালিয়ে আসছিলো যে, ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ঘিরে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে। কিন্তু স্যাংশন ও নিষেধাজ্ঞার তালিকা সামনে আসার পর দেখা গেছে, সেখানে বাংলাদেশের কারো নাম নেই। আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞো হাতিয়ার বানিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে বিএনপি-জামায়াত জোট। বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে বিশ্বে নেতিবাচকভাবে ফুটিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে যারা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ায়, বাংলাদেশের কারো নাম না থাকার বিষয়টি তাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পরে অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে একটি কূটনীতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভীত গড়েন, যার ফল আজ আমরা পাচ্ছি । বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে টালমাতাল, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভাবে ভঙ্গুর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই ক্রান্তিকালে জাতির পিতার সুযোগ্য তনয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলো দক্ষভাবে পরিচালিত করে দেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংগঠিত করেছেন। যার ফলাফল আমরা যুক্তরাজ্য ও কানাডার স্যাংশন তালিকা দেখেই বুঝতে পারি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের এই শক্তিশালী অবস্থান আসন্ন নির্বাচনে যথেষ্ট ভুমিকা রাখবে।
যুক্তরাজ্য-কানাডা নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে বাংলাদেশের বাদ পড়া, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই ইতিবাচক অগ্রগতি শুধু বাংলাদেশের কূটনৈতিক দূরদর্শিতার প্রতিফলন নয়, এটা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করে। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যুক্তরাজ্য ও কানাডার অনবদ্য প্রভাব রয়েছে। তাই নিশ্চিত করে বলা যায়, এই দুই দেশের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।