পলাশ আহসান
অবশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে ব্যাপক অপপ্রচারের কথা স্বীকার করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। এনিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জানার পর মনে মনে বললাম যাক বাবা বাঁচা গেছে। শেষমেষ তিনি উদ্বিগ্ন হতে পেরেছেন। যদিও তার উদ্বিগ্নতার কারণ খানিকটা পক্ষপাত দুষ্ট। তবুও হোন… কারণ দেশের বহু মানুষ একই কারণে উদ্বিগ্ন। প্রতিবারের মত সাংবাদিকের ছদ্দবেশে কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের সরকার বিরোধী একটা প্রশ্ন করেছেন এবং তিনি সেই প্রশ্নের জবাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ওই সাংবাদিক মিলারের কাছে জানত চান, নির্বাচন সামনে রেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও দেশের বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। এসম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী? এর প্রমান হিসাবে ও্ই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন। মিলারের প্রতিটি ব্রিফিংএ এধরণের প্রশ্ন থাকে। আমি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের লেখাটা পড়েছি। কিন্তু এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে অপপ্রচারের কথা বলা হয়েছে সেটা দেখার সুযোগ হয়নি। ওই রিপোর্টেই বলা আছে ফেসবুকে প্রচারিত অপপ্রচারটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
আমার লেখার শুরুটা মূলত এখান থেকে। কারণ বাংলাদেশে নিবোচনের আগে অপপ্রচার নিয়ে কথা বলতে হলে এখান থেকে শুরু করতে হবে। পাঠক আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এরই মধ্যে ম্যাথু মিলারের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং আমাদের দেশে এখন খুব পরিচিত। প্রায় প্রতিটি ব্রিফিং একই রকম। এখানে সারা বিশ্বের নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্ররে অবস্থান নিয়ে তিনি কথা বলেন। গড়ে ৪০/৪৫ মিনিটের ওই ব্রিফিংএ বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেন দুই মিনিট। সেটারও একটা খণ্ডাংশ নিয়ে মাতামাতি হয় বাংলাদেশে। প্রথমত সেই উত্তর এমনভাবে প্রচার হয়, যেন মনে হয় এই কথাটি বলার জন্যে মিলার ব্রিফিংটা করছিলেন।
মিলারের এই ব্রিফিংএ বাংলাদেশর সরকার বিরোধী প্রশ্ন করা হয়, সেটার উত্তর নেয়া এবং রেকর্ড করে প্রচার করাটা যে, একটা অপপ্রচারের কূটকৌশল তা এখন বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারেন। মিলার সাহেবরা শুরুতে বিষয়টি শুরুতে ধরতে পেরেছিলেন কী না আমি জানি না। কিন্তু এখন সম্ভবত বোঝেন, কারণ দেখা যায় ইদানিং কালের ব্রিফিংগুলোতে প্রশ্ন আসে তিনটা। এর মধ্যে মিলার দুটি এড়িয়ে যান, একটি উত্তর দেন। সেটারই অপভ্রংশ প্রচার হয় আমাদের দেশে। এবার নির্বাচনের আগের অপপ্রচার নিয়ে প্রশ্নটা যে আগের ধারবাহিকতা নয় সে নিশ্চয়তা কী কেউ দিতে পারে?
এখন ফেসবুকে প্রচারিত অপপ্রচারের বিষয়টিকে যদি কেউ পরিকল্পিত বলে। কেউ যদি বলে যে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার যে বিষয়টি তৈরি এবং প্রচার হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেটি একটি পরিকল্পিত মিথ্যাচার। এটি প্রচারই হয়েছে মিলারের ব্রিফংএ প্রশ্ন তোলার জন্যে। খুব কী ভুল হবে? মিলার সাহেব বলেছেন তার চোখে খবরটি পড়েছে। অথচ দিনের পর দিন অপপ্রচারের সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে সেবিষয়টি চোখে পড়লো না। তাই বাংলাদেশের গুজব নিয়ে কোন কথাও বললো না যুক্তরাষ্ট্র। অদ্ভুদ বলেও ভুল হয়। অবাক হওয়ার জন্যে এখানে নতুন টার্ম ব্যবহার করতে হবে।
আমি সাধারণত উদাহরণ দিয়ে লিখতে পছন্দ করি। যে গুজবের বিষয়টি মিলার সাহেবদের চোখে পড়ে না, সেরকম উদাহরণের জন্যে আমি সাম্প্রতিক বাংলাদেশের শিক্ষা কারিক্যুলাম নিয়ে একটি অপপ্রচারের উদাহরণ উল্লেখ করবো। বাংলাদেশে রিউমর স্কানার নামে একটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য চিহ্নিত করার কাজ করছে। তাদের ওয়েবপেজে চিহ্নিত করার খবরটি এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে নতুন শিক্ষা কারিক্যুলামে কয়েকজন শিক্ষক গোল হয়ে একটি ছড়া আবৃত্তি করছে। আসলে ওই ছবিটি বাংলাদেশের নয় । আরও ৩/৪ বছর আগের পাকিস্তানের একটি ছবি। সরকারের শিক্ষা কারিক্যুলাম নিয়ে ব্যাঙ্গ করতে এমন বহু অপপ্রচার হচ্ছে দিনের পর দিন।
শুধু শিক্ষা কারিক্যুলাম কেন, এরকম শত শত অপপ্রচারে ভাসছে গোটা দেশ। নির্বাচন যত কাছে আসছে ততই বাড়ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নিত্য নতুন বের হচ্ছে অপপ্রচারের কৌশল। তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার সেই বিষটার অন্যতম প্রভাবক হিসাবে কাজ করছেন। ভাবাই যায় না। কার্ড বলে একটা বিষয় যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে যেকোন একটি পত্রিকার ছাপা খবরসহ একটি স্থির চিত্র দেয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে গোটা কার্ডটাই বানানো। খবরের মত দেখায় এরকম একটি অপপ্রচার লিখে একটি পত্রিকার নাম বসিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হলো। অথচ ওই পত্রিকাও কিছু জানে না। যার বিরুদ্ধে অপপ্রচার তিনিতো জানেনই না। এটা চাইলেও কেউ সরিয়ে নিতে পারবেন না।
যতক্ষণে সরিয়ে নেয়া হবে ততক্ষণে তা ছড়িয়ে পড়বে দেশময়। নানা যায়গা থেকে স্বজনরা ফোন করতে শুরু করেছেন। যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না তারা আনন্দে নাচতে শুরু করেছেন। এখন হয়তো আপনি লিখলেন এটা মিথ্যা কথা। কিন্তু সেটা কিন্তু আগেরটার তুলনায় ছড়াবে না। আপনার এবং ওই পত্রিকার ভাবমূর্তির ১২টা বেজে গেছে ততক্ষণে। কিন্তু আপনি তখনও বুঝতে পারেন নি কে করলো এমন মিথ্যা্চার। বিনামেঘে বর্জ্যপাত এর এমন ঘনিষ্ট উদাহরণ বোধ আর হয় না। পাঠুক ভাবুন এই দুর্যোগ যদি নির্বাচনের সময় সময় হয় তখন কী অবস্থা হবে! ভেবে অবাক হওয়ার কিছু নেই এটার আমাদের দেশে অহরহ হচ্ছে। আমিতো কার্ডের কথা বললাম। অপপ্রচারের আরও নানা কাঠামো এখন আমাদের চার পাশে।
গত অক্টোবরেই সরকার সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশ-বিদেশে গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। সভা শেষে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছিল নিয়মিত সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নানা জটিলতায় যথাযথ জবাব দিতে পারছে না । আরও বলা হয় প্রবাসীদে অপপ্রচার করার প্রবণতা বেশি। এরই মধ্যে সেসরকম কিছু প্রবাসী নেমেছে অপপ্রচারে। তাদের জবাব দেয়া হচ্ছে। তবু সরকারের মত একটি নিয়মবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে, বিচ্ছিন্ন লোকজনের অপ্রচারের জবাব দেয়া সম্ভব নয়। হাতে যথা যত তথ্য প্রমাণ থাকার পরেও নয়।
গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চলক নিয়ে একটি প্রতিবেদর প্রকাশ করেছিল রিউমর স্কানার। সেখানে বলা হয় ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে সবচেয়ে বেশি ভুয়া সংবাদের শিকার হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে এসব ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে মোট ৪৩টি ভুয়া খবর ছড়ানো হয়। রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশ এসব ভুয়া নিউজ শনাক্ত করে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরে বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়ে প্রচার করা হয়েছে ১২টি খবর। এর বাইরে বাংলাদেশ পুলিশের বিষয়ে ১৪টি গুজব ছড়ানো হয়েছে।
এত হিসাব দেয়ার কারণ শুধু যে মিলারের কথা বা উদ্বেগ তা কিন্তু নয়। দেশের মানুষের উদ্বেগের কথাও বলেছিলাম। মানুষের সেই উদ্বেগ আগামী নির্বাচন নিয়ে। অপপ্রচারের যে বর্ননা দিচ্ছি এই পরিস্থিতি কিন্তু আজ পর্যন্ত রয়েছে। কমার বা নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ নেই। দোর্দণ্ড প্রতাপে অপপ্রচার চলছে। চলবে আশঙ্কা করা যায়। আজকাল নির্বাচনী প্রচার বাজেটের একটি একটি বড় অংশ ব্যায় করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দখলে। তাতে আমার সমস্য নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর অপব্যবহার হলে। ব্যবহার হচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যবহার এখনও অপব্যবহারকে ছাড়াতে পারেনি। এটাই বিপদের। আরও বিপদ হচ্ছে এখানে নাম পরিচয় গোপন করেই অন্যের নামে অপপ্রচার করা যায়।
কথা হয়েছিল এবারের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করবে ফেসবুক ও ইউটিউব। এনিয়ে তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকও করেছিল। কিন্তু নির্বাচনী কার্যক্রম মাঝামাঝি পর্যায়ে অথচ একনও ফেসবুক ও ইউটিউবের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার কোন আলামত পাওয়া যায়নি। যাবে বলেও মনে হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এনকম প্রবল অপপ্রচারেই মুখেই থাকবে আমাদের জাতীয় নির্বাচন? মিলার সাহেবরা উদ্বেগ জানিয়ে খালাস হয়ে যাবেন কিন্তু কিন্তু আমাদের সুষ্ঠু নির্বা্চন কোথায় যাবে? তারাই তাদের প্রতিপত্তি খাটিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন গুজব মুক্ত করার সহায়তা দেয়ার কথা বলতে পারতো ফেসবুক ও ইউটিউবকে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।