নিজস্ব প্রতিবেদক

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়ার পরিকল্পনায় গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বিএনপি উচ্চপর্যায়ের নেতাদের চাপ ও দেশে–বিদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে রেললাইনে নাশকতার পরিকল্পনা হয় আজমল ভূঁইয়ার বাড়িতে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আটজন মিলে রেললাইনের কিছু অংশ কেটে রাখেন।

রোববার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কমিশনার মো. মাহবুব আলম। এ ঘটনায় বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাশকতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী সদস্যরা সবাই বিএনপি এবং তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা এবং সক্রিয় সদস্য বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

গ্রেপ্তার সাতজন হলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হাসান আজমল ভূঁইয়া (৫০), জান্নাতুল ইসলাম (২৩), মেহেদী হাসান (২৫), জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয় (৩৫), শাহানুর আলম (৫৩), মো. সাইদুল ইসলাম (৩২) ও সোহেল রানা (৩৮)। এর মধ্যে আজমল ভূঁইয়া গাজীপুর সদর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। জান্নাতুল ও মেহেদী বিএনপির কর্মী। সোহেল রানা গাজীপুরের কাজী আজিম উদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। শাহীনুর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি, হৃদয় ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাইদুল গাজীপুর সদর থানা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি।

পুলিশ কমিশনার জানান, ঘটনার পরপরই গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা গতকাল (শনিবার) দুঃষ্কৃতিকারী দলের সদস্য জান্নাতুল ইসলামকে (২৩) আটক করো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জান্নাতুল জানান, ট্রেনে নাশকতার ঘটনা ঘটানোর উদ্দেশ্যে তারা কোনাবাড়ী থেকে ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একটি হায়েচ গাড়ি (মাইক্রোবাস) ঢাকা যাওয়ার কথা বলে ভাড়া করে। তারা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা থাকলেও ঢাকায় না গিয়ে গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। এসময় মাইক্রোবাসে থাকা আরোহী সবাই মুখোশ পরা অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় ড্রাইভার ভয় পেয়ে, তাদের ঢাকায় না যাওয়ার কারণ এবং মুখোশ পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তাদের মধ্যে একজন মুখোশ খুলে। এসময় তাদের চেনো কিনা জানায় তারপর ড্রাইভার তাকে চিনতে পারলেও কিছু বলতে সাহস পায়নি। পরে তারা ভাড়াকরা মাইক্রোবাস নিয়ে রেল লাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে বের হয়।

তিনি আরও জানান, পথিমধ্যে তারা গাজীপুর শহরের শিববাড়ীর জোড় পুকুরপাড় এলাকারসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গাড়িতে উঠায়। পরে তারা গাজীপুর শহরের জোড় পুকুরপাড়স্থ ইবনে সিনহা হাসপাতাল এলাকায় তোহার বাসা থেকে রেল লাইন কাটার যন্ত্রপাতি, দক্ষিণ সালনা উসমান গণির ভাড়া দেওয়া “বাঁশ বাগান” রেস্টুরেন্ট থেকে দুইটি গ্যাস সিলিন্ডার গাড়িতে উঠায়। এসব সরঞ্জাম নিয়ে তারা শিববাড়ী মোড় থেকে দুইজন ব্যাক্তিকে উক্ত গাড়িতে উঠায়। এরপর গাজীপুর শহরের ভেতরে বিভিন্ন অলি গলিতে ঘোরাঘুরি করে রাত ১০টায় শিমুলতলী এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খায়। রাতের খাবার শেষে ১১টায় হোটেল থেকে বের হয়ে ফের গাড়িতে সময় ক্ষেপনের জন্য শহরের ভিতরে বিভিন্ন অলি গলিতে ঘোরাঘুরি করে। রাত দেড়টার দিকে ঘটনাস্থল শ্রীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় ৪-৫ কিলোমিটার দূরের বনের পাশে গাড়ী রেখে পায়ে হেঁটে তারা গ্যাস সিলিন্ডারসহ সরঞ্জামাদী নিয়ে বনখরিয়া চিনাই রেল ব্রিজের পাশে যায়। সেখানে গিয়ে তারা একত্রে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে এবং সুযোগ বুঝে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল সড়কের ২০ ফুট রেল লাইন গ্যাস কাটার দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর কিছু সময় পর ওই রেল সড়কে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ভোর ৪টা ১৫মিনিটের দিকে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

এ ঘটনার ঘটিয়েই তারা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে চার জন গাডড়ি থেকে নেমে যায়। বাকী সদস্যরা পরবর্তীতে মিরপুরে গিয়ে নামে। মিরপুরে নেমে তারা নিজেদের কাছে টাকা না থাকায় ফোনে অন্য একজনকে ড্রাইভারের নাম্বারে টাকা পাঠাতে বলে। সেই মোতাবেক জনৈক ব্যাক্তি ড্রাইভার সাইফুলের বিকাশে ৮হাজার ১০০ টাকা পাঠিয়ে দেয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গত ১১ ডিসেম্বর রাতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ২৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাবেক বিএনপি নেতা আজমল ভূঁইয়ার বাসাসহ বিভিন্নস্থানে সভা হয়। ওই সভায় রেল লাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা করা হয়। উক্ত সভায় এ আলোচনা হয় যে, দলীয় উচ্চ পর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ আছে, বড় কোন ঘটনা ঘটলে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। এজন্য তারা রেল লাইনে নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাপক প্রাণহানির ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য রেললাইনকে বেছে নেয়া হয়েছিল তারা।

গত বুধবার ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের বনখরিয়া এলাকায় আন্তনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার রাতের কোনো একসময় গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর ও ভাওয়াল রেলস্টেশনের মাঝামাঝি রেলপথের একটি অংশ কেটে রাখে দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে ১ যাত্রী নিহত ও অন্তত ১২ জন আহত হন।