প্রফেসর ড. রোজীনা ইয়াসমিন (লাকী)
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”। সভ্যতার অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে নারী ও পুরুষের সমান অবদান অনস্বীকার্য। নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের একক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নের কথা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু যুগ যুগ ধরে নারীরা অবহেলিত ও শোষিত হয়ে আসছে।
পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীরা তাদের অধিকার বিসর্জন দিয়ে আসছে। নারীরা তাদের প্রতিভার বিকাশ ও আত্মপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ থেকে ক্রমে বঞ্চিত হচ্ছে।
নারীকে পূর্ণ মর্যাদা প্রদান, তার মেধা ও শ্রমকে শক্তিতে রূপান্তর করে এবং তার স্ব-নির্ভরশীলতাকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র নির্বিশেষে সারা বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাপক অর্থে একজন নারীর স্বকীয়তা, নিজস্বতা, সর্বোপরি স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিকাশকে বোঝায়। নারী-পুরুষের মধ্যকার অসমতা ও বৈষম্য দূর করে নারীকে পুরুষের সমকক্ষে প্রতিষ্ঠিত করাই হলো নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন করতে হলে নারীকে ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা এবং নারীদেরকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। সমাজ ও অর্থনীতিতে নারীর অবদান যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে এবং তাদের উপর নির্যাতন করা প্রতিরোধ করতে হবে, তবেই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে।
নারীর ক্ষমতায়ন বলতে এমন একধরনের অবস্থাকে বোঝায়, যে অবস্থায় নারী তার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীন ও মর্যাদাকর অবস্থায় উন্নীত হতে পারে। নারীর ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন কোনও বাধা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নারী শিক্ষা, কর্মজীবন এবং নিজেদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে পারবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি নারীদের ক্ষমতায়নের পথিকৃৎ। ১৯৬৭ সালে মহিলা লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নারীদের মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সব পর্যায়ে নারীদের সম অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় এবং নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতাও সংযোজন করা হয় (অনুচ্ছেদ ২৭ ও ২৮)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ অনুসরণ করেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই সব পর্যায়ে লিঙ্গ সমতা, নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য অসংখ্য নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করেন এবং বাস্তবিক অর্থে সব পর্যায়ে তা সুসংহত ও কার্যকর করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন।
শিক্ষায় নারীদের শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাজনীতিতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য শেখ হাসিনার গৃহীত উদ্যোগ ও সাফল্য অভাবনীয়।
সরকারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষার ব্যবস্থাও করেন শেখ হাসিনা। যে কারণে দেশে নারী শিক্ষার হার অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হারে এগিয়ে রয়েছে ছাত্রীরা। এ বছর এসএসসিতে সারা দেশে পাসের হার ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছাত্রদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ছাত্রীদের ৮১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ বছর এইচএসসিতে ছাত্রীদের পাসের হার যেখানে ৭৮ দশমিক ৬১ শতাংশ, সেখানে ছাত্রদের মধ্যে পাস করেছে ৭২ দশমিক ৯১ শতাংশ (মাউশি,২০২৩) মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে বলেই সমভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত নারীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। তিনি প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক বাধ্যতামূলক করেছেন। বাল্যবিবাহ রোধ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন করেছে শেখ হাসিনা সরকার। সন্তান জন্মের পর আগে অভিভাবকের জায়গায় শুধু পিতার নাম লেখা হতো, এখন মায়ের নামও লেখা হয়।
জননেত্রীর এ বিশেষ উদ্যোগের কারণে সমাজে মায়ের অধিকার এবং আত্মসম্মান কাগজে-কলমেও স্বীকৃতি পেয়েছে।রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর সম অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার কার্যকর ভূমিকা দীর্ঘদিনের নারী আন্দোলনের দাবি। বাস্তবতার চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা চালু এবং এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি করা হয়নি। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতেও কোনো প্রকার সংধোশন বিল আনা হয়নি।
প্রশাসন এবং প্রশাসনিক কাঠামোগুলোতে নারীর কার্যকর জবাবদিহিতামূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনের বিধান না রেখে মনোনয়নের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন ৫০টিতে উন্নীত করে ২৫ বছরের জন্য বহাল রাখা হল।
এই বিলটি ঘোষণার ফলে নারীর অগ্রযাত্রা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পদক্ষেপ চাপা পড়ে গেল। এই বিলটি বাংলাদেশের নারীসমাজের জন্য অসম্মানজনক। কাজেই সরকারকে এই বিলটি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তাই সময়ের দাবি পূরণের লক্ষ্যে জনকল্যাণমুখী, জবাবদিহিতামূলক, দুর্নীতি-সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, সুশাসন ও সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনা, জেন্ডার সংবেদনশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধ ও স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য প্রয়োজন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীরা অগ্রসর হলেও নারীর সার্বিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, বিশেষ করে বাল্যবিবাহ (৫৪ শতাংশ) রোধসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন একটা অপরিহার্য অংশ।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাহীন, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনকালসহ আওয়ামী লীগের শাসনকালগুলো এ দেশের নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী শ্রমবাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর একটি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ। ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, গ্রামীণ নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার শহরের নারীর তুলনায় বেশি।
আবার পোশাক খাত ছাড়াও এখন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, যোগাযোগ খাত, রিয়েল স্টেট সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং, ইনস্যুরেন্স খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মোট পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পোশাক খাতের পরই প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উইমেন ইন পার্লামেন্ট ও ইউনেসকো কর্তৃক দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জেন্ডার অসমতা কমানোয় নেতৃত্বের জন্য উইমেন ইন পার্লামেন্ট ফোরাম পুরস্কার আর ইউএন উইমেন কর্তৃক শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েদের অগ্রগতির অসামান্য অর্জনের জন্য ‘ট্রি অব পিস’ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৬ সালে তিনি নারী ক্ষমতায়নের জন্য আরো দুটি স্বীকৃতি লাভ করেন। একটি হলো ইউএন উইমেন কর্তৃক প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার আর অন্যটি হলো গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম কর্তৃক এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড। ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশ এশিয়া ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারীশিক্ষা ও নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে নেতৃত্বদানের জন্য গার্লস উইমেন সামিট কর্তৃক গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম-এর (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের ১৬তম সংস্করণের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১। লিঙ্গ সমতায় ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ থেকে এগিয়ে আছে। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।
লেখক: প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, সোস্যাল সাইন্স এণ্ড হিউম্যানিটিস অনুষদ ও সাধারণ সম্পাদক, গণতান্ত্রিক শিক্ষক পরিষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।