বিশ্বজিৎ দত্ত

‘জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতা সবসময়ই অনিশ্চয়তায়’ বিষয়টি যে কত সত্য তা আজকের (সোমবারের) বেশিরভাগ গণমাধ্যমের শিরোনাম দেখলেই বোঝা যায়। যেমন ধরুন ‘‘জাপা‌র সঙ্গে আ.লী‌গের টানা‌পো‌ড়েন হ‌বে, এমন‌টি নয় : কাদের’; ‘আ.লীগ-জাপা ফের বৈঠক দু-একদিনের মধ্যে জাতিকে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা দিতে পারব : নাছিম’; ‘স্ত্রীকে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য বানালেন জি এম কাদের’; ‘আ. লীগ-জাপা সন্দেহে আটকে আছে সমঝোতা’; ‘জয়ের নিশ্চয়তা চায় জাপা, চাপে রাখছে আ’লীগ’; ‘নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য আসেনি জাতীয় পার্টি’; ‘জাতীয় পার্টির নির্বাচনে থাকা না-থাকা নিয়ে শঙ্কা’; ‘জাতীয় পার্টি ঘিরে নাটকীয়তা’।

পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন এখনকার আলোচনার বিষয় জাতীয় পার্টি। এখন প্রথম  প্রশ্ন, পত্রিকার এইসব শিরোনাম পড়ে কিছু কি বোঝা গেল? একটা বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির যে অবস্থান থাকার কথা তা কী আছে? সামনে নির্বাচন। এখন দলে আলোচনা হওয়ার কথা ইশতেহার, প্রচার কৌশল, জোট পলিসি নানা ইস্যু। অথচ সে সবের বালাই নেই, দলের মধ্যে দুই শীর্ষ নেতা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করছে, সেটাই সবাই দেখছে। সেই ঝগড়ার মীমাংসা করার জন্য রওশন এরশাদ আবার গিয়েছেন শেখ হাসিনার কাছে। কতটা হাস্যকর এবং ছেলেমানুষি কর্মকাণ্ড তা যে কেউই বুঝতে পারে।

এই হচ্ছে জাতীয় পার্টি। রাজৈনীতির ব্যানারে ব্যক্তিগত চর্চার আখড়া বলা যায়। অথচ তাদের বেশিরভাগ নেতাই মাঠের সফল জনপ্রিয় নেতার ঢেকুর তোলেন। আনেকটা গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লের মত৷  অথচ তারা পেছন ফিরে কখনও দেখে না৷ তাই বুঝতেও পারে না যে, নির্বাচনে তারা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না।  সারাদেশে তাদের ভোটার কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

আমরা যদি পরিসংখ্যানে যাই তাহলে দেখা যাবে, ৯০ এর পর থেকে জাতীয় পার্টির শান সৈকত হাওয়া হতে থাকে। হুসেইন মোহাম্মদ  এরশাদের মৃত্যুর পর সেই সমীকরণ এসে ঠেকেছে শূন্যের কাছাকাছি। আমরা যদি ইতিহাসমুখী হই দেখা যাবে,  জানুয়ারি ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এরশাদ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় পার্টি সুস্থির রাজনীতি করেছে এমন নজির নেই। ক্ষমতায় আসার পরই স্বৈরাচারী ক্ষমতা নিয়ে একটানা টিকে ছিল।

এরপর রাজনীতির মূল ধারায় আসার পর দেখা যায় তাদের আসল রূপ। সকালে এক কথা বললে, দুপুরে আরেক কথা বলেন, সন্ধ্যা নাগাদ সকালের সেই কথার আশেপাশেই থাকেন না জাতীয় পার্টির নেতার। অনেক বেশি মাত্রায় আনস্টেবল এবং আনপ্রেডিক্টেবল। এটা দেশবাসীর কাছে খুব পরিচিত।

আবারও যদি পেছন ফিরি কী দেখা যায়, ১৯৮৬ সালের ৭ মে এরশাদের অধীনে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫৩ আসন নিয়ে তারা সরকার গঠন করে। সেই নির্বাচন এখনো কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনের আওতায় আনেন না। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ এরশাদের অধীনে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন পায়। এটি ছিল মূলত একদলীয় নির্বাচন।  ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন থেকে মূলত অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন শুরু হয় বাংলাদেশে। এখানে  জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পায়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টি এই নির্বাচন বয়কট করেছিল। আওয়ামী লীগসহ অনেক দল অংশ না নেওয়ায় এই সংসদের বিরোধী দল ছিল না। মাত্র ৪ দিন স্থায়ী ছিল এই সংসদ।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি আসন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন পায়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টি ২৭টি আসন পায়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসন পায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতীয় পার্টি পায় ২২টি আসন।

এই দুই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, ১৯৮৬ আর ১৯৮৮ বাদে জাতীয় পার্টি এমন কোনো নির্বাচনে আসন পায়নি যার জন্য জাতীয় পার্টিকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে মনে হবে। ৮৬ আর ৮৮ বাদ দিলে এত বছরের নির্বাচনে এই দল কোন অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনে ৫০টি আসন পায়নি৷ তাহলে তাদের নিয়ে কেন এত আলোচনা? কেন তারা নিজেদের এর গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে তা আসলে কেউ বুঝতে পারছে না।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও জাতীয় পার্টির তেমন প্রস্তুতি এখনো চোখে পড়েনি। তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসবে কি না তাই বোঝা যাচ্ছিল না। প্রতিবাদ নির্বাচন আসলে তাদের এমন নানা ধরনের নাটক দেখা যায়। এইসব নাটক গণমাধ্যম খুব গুরুত্ব সহকারে প্রচার করলেও জনগণ আসলে বিরক্ত। তারা ওই সময় কিছু বলতে না পারলেও ফলাফল জানান ভোটের মাঠে।

যে দুইবার এরশাদের অধীনে নির্বাচন হয়েছে সেটা বাদে বাকি কোনো নির্বাচনে তারা ৫০টির আসনও পায়নি। এতেই বোঝা যায় তাদের হাঁকডাক অনেক, কিন্তু ভোটার নেই। অনেকটা ইসলামী দলগুলোর মতো। ইসলামী দলগুলোর সারাবছর কোনো খোঁজ থাকে না। অথচ নির্বাচনের আগে তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে।আদতে তাদের কোনো ভোট নেই। যদিও ভোটই থাকতো তবে তারা ছোট-বড় যেকোনো নির্বাচনে ভোট পেত। জনগণ আসলে স্বস্তি চায়, উন্নয়ন চায়, শান্তিতে বাস করতে চায়—এইসব দিক বিবেচনায় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বরাবরের মত হাস্যরসের খোরাক হয়েই আছে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।