পলাশ আহসান

সব শেষ চিঠিতেও ডোনাল্ট-লু লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করবে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র থ্রি সি নীতি বা ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। পাঠক আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গত ১৩ই নভেম্বর এরকম একটি চিঠি নিয়ে আমাদের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের কাছে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রতিনিধিরা। সুষ্ঠু নির্বাচনে আগ্রহ দেখিয়ে তিন দলই চিঠির জবাব দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচেনের পথে এখনও হাঁটছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। বিএনপি যাত্রা উল্টোদিকে। 

দেশে নির্বাচনের ঢোল বেজে গেছে গত ১৫ই নভেম্বর। ২৯টি রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্র মিলিয়ে পৌনে তিন হাজার প্রার্থী প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তারা সবাই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার জন্যে আইন প্রনেতা হতে চান। নেতা হওয়ার উৎসব লেগেছে দেশে। কিন্তু বিএনপির অনুপস্থিতিতে এই নির্বাচনী উৎসবের ঘাটতি হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে সেই পদ্ধতি তাদের পছন্দ নয়। কিন্তু তাদের পছন্দের পদ্ধতি আবার তিন ভাগের দুইভাগ রাজনৈতিক দলের অপছন্দ। বিশ্ববাসীরও অনুশীলনও অপছন্দের দিকে। সেই পদ্ধতি যারা পছন্দ করেন তাদের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের নামও নেই।

কিন্তু নির্বাচন তো করতে হবে। কেন বিএনপি নির্বাচনে যাবে না? কোন পদ্ধতির নির্বাচন ভালো? নির্বাচনে যেতে হলে তাদের শর্ত কী? তাদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক? এসব নিয়ে এরইমধ্যে নামী বিশ্লেষকরা লিখেছেন এবং লিখছেন। ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই লিখবেন। কিন্তু গত এক বছর ধরে নির্বাচনী আলোচনায় ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। যদি বলি ভিসা নিষেধাজ্ঞাই আমাদের এই মুহূর্তের আলোচনার কেন্দ্র তাতেও খুব ভুল হয় না। কারণ এখন মানুষের আগ্রহ, ভিসা নিষেধাজ্ঞার তীর এখন কোন দিকে? সরকারি দলের বন্ধুরা ভাবছেন একটা ভালো নির্বাচন করতে পারলে কী চাপমুক্ত হওয়া যাবে? আর বিএনপির বন্ধুরা চিন্তা করছেন ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে তো নির্বাচন ঠেকানো গেলো না। এর পর কী হবে?

শুরুতে দেখি বিএনপির অবস্থা। লু’র চিঠি অনুযায়ী নির্বাচনে না আসার সিদ্ধান্ত নেয়াইতো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রথম বাধা। কারণ নির্বাচনে না এসে কীভাবে বলা যাবে নির্বাচন ভাল হবে না? তারা ২০১৪ এবং ২০১৮ নির্বাচনের উদাহরণ টানতে পারেন। সেই নির্বাচনের একটিতে তারা আসেইনি,আরেকটিতে অংশগ্রণ করেছিল শুধু, মাঠে নামেনি। কোন প্রচার ছিল না, ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। মাঠে নামলে ৩৯ শতাংশ ভোটের মালিক যে দল সেই দল কীভাবে মাত্র ৬টি আসন পায়? এই বিশাল ভোটারগোষ্ঠীকে ঠেকিয়ে রাখতে কত বাধা দেয়া যায়? অথচ এবার বহু ভোটার বিএনপির পক্ষে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছিলেন। তারা হাতাশ হলেন। 

ভোটারদের মনে কষ্ট দেয়ার বিষয়টি ছোট বাধা মনে হতে পারে মোটা দাগে। সেই অনুযায়ী বড় বাধার কথা বলতে হয় নির্বাচনী কার্যক্রমের সময় বিএনপির ডাকা ১১টি অবরোধের কথা। মাঝে মধ্যে কয়েকটি হরতালও পড়েছে। প্রতিটি হরতাল-অবরোধে ঘটছে যানবাহন ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার ঘটনা। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, এবারের অবরোধে ক্ষতির পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শ্রমিকরা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, বাস বন্ধ থাকলে তো পেটে ভাত জোটে না। তাই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়।

অবশ্য এবারের অবরোধে এখনও তুলনামূলক কম নৃশংসতা হয়েছে। গণমাধ্যমের তথ্য বলছে ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে সহিংসতা আরও এগিয়ে ছিল। টানা ৯২ দিনের অবরোধে পেট্রোলবোমায় তিনশ এর বেশি মানুষের গায়ে আগুন দেয় অবরোধ সমর্থকরা। এদের মধ্যে ১৩৪ মারা গিয়েছিলেন। এক হাজার ৯৭০টি যানবাহন পোড়ানো হয়েছিল। যেন ভোট না হতে পরে সে জন্যে আগুন দেয়া হয়েছিল ১১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে সেবার ক্ষতি হয়েছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালের সামনে কোন নিষেধাজ্ঞার ভয় ছিল না। কিন্তু এবার আছে। ভোটে বাধা দেয়ার ক্ষতির পবিমান ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আরও বাড়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।

আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সহিংসতা ও পরবর্তীতে বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল থিংক ট্যাংক ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি)-এর একটি প্রতিবেদনে। গত ২২শে নভেম্বর তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয় গত ২৮ শে অক্টোবর বাংলাদেশে সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বেশ কয়েকজনকে গুরুতর আহত করেছে। একটি পুলিশ হাসপাতালে আগুন দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করেছে এবং সাংবাদিকদের  ওপর হামলা করেছে। 

এবার আসি আওয়ামী লীগের কাছে। শর্ত অনুযায়ী এখনও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে আছে তারা। বিএনপির মত একটি বড় দল না আসলেও শুরুতে পৌণে তিন হাজার প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামাতে পেরেছে। ঘোষণা দিতে পেরেছে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে কেউ জয়ী হতে পারবে না। এখনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ঘটনা নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও প্রত্যেকের মোটামুটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। বলা যায় অংশগ্রহন মূলক নির্বাচন মোটামুটি নিশ্চিত।

এখন দেখার বিষয় কতটুকু সুষ্ঠু হচ্ছে নির্বাচন? তবে সেটা বলার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত। যদিও এরইমধ্যে কিছু আশাব্যাঞ্জক আলামত পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রটোকল ছাড়াই ব্যক্তিগত সফর করছেন। মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরাও প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ করছেন। ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও ব্যপক প্রস্তুতি নিয়েছে। পদ ছেড়েছেন টেকনোক্রেট মন্ত্রীরাও।

আলোচনার সুবিধার জন্যে আবারও ইউএসআইপি এর প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য পশ্চিমা সরকারগুলো রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উন্নতির জন্য চাপ দিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিরোধীরা এই চাপ সুযোগ হিসাবে নিচ্ছে। তারা ধারাবাহিকভাবে মার্কিন নীতি ও বিবৃতির প্রশংসা করেছে। তাদের একজন বিএনপি নেতা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তার দলের ‘ত্রাণকর্তা’ বলে অভিহিত করেছেন।

এর মধ্যেই বার বার আলোচনায় আসছে ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ। সরকার বিরোধীরা দিনের পর দিন এটিকে সরকারের প্রতি বিদেশি চাপ হিসাবে প্রচার করেছে। যে কারণে বিভিন্ন মহল ‘অযাচিত ও অযৌক্তিক’ রাজনৈতিক চাপ দিচ্ছে- এমন অভিযোগ তুলে জাতিসংঘকে চিঠি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি জানান, “জাতিসংঘকে লিখেছেন, শেখ হাসিনা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু একইসঙ্গে বিক্ষোভের নামে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি পোড়ানো ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যার বিষয়টি তিনি সহ্য করবেন না। বাংলাদেশ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও মানুষের সম্মান রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে” ।

ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নানা তথ্য দেয়া হলো ভোটার বা পাঠকের সামনে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন যদি ভিসা নিষেধাজ্ঞার মাপকাঠি হয় তাহলে কার পাওয়া উচিত সেই নিষেধাজ্ঞা? তার চেয়েও বড় কথা ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এই ভীতি অথবা প্রীতি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো আমাদের রাজনৈতিক জীবনে? এটা নিয়ে অবশ্য দুর্দান্ত বিতর্ক হতে পারে। আপাতত সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। শুধু বলছি আমরা কাজ করি, ভাত খাই। তার পর গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ি। এই অযাচিত বিতর্কের ধার কাছ দিয়েই বা আমরা বার বার হাঁটছি কেন?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।