মো. আজাদ মন্ডল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের ভৌগোলিক মুক্তির রোল মডেল, আর তার কন্যা শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক মুক্তির রোল মডেল। শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতায় ১৫ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির সব সূচকে যুগান্তকারী মাইলফলক স্পর্শ করেছে।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এই তিনটি সূচকের যেকোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ—যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস, সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে আমরা দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) বাস্তবায়ন করছি এবং একটি সমৃদ্ধ রাজস্ব ভাণ্ডার গড়ে তোলার ওপর প্রাধান্য দিচ্ছি। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় পেশাগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষ, যুগোপযোগী ও জনবান্ধব রাজস্ব প্রশাসন গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছি।

শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক।

পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ। এতে প্রদর্শন করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বান, আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ শতাংশে। স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়।

মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোয় ২ হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩ তে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্য শস্যের মোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০৭.০৮ লাখ মেট্রিক টন এবং বাস্তবে উৎপাদিত হয় ৩৯১.২৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪২৭.৩২ লাখ মেট্রিক টন।

পরিশ্রমী কৃষক, মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানী সরকারের নীতি সহায়তা এবং কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের যৌথ প্রয়াসেই এই সাফল্য। বিশ্বে বাংলাদেশ (i) ধান ও চাল উৎপাদনে তৃতীয়, (ii) দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সবজি  উৎপাদনে তৃতীয়, (iii) অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, (iv) বিশ্বে বাংলাদেশ মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ উৎপাদন করে, (v) গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১২তম, (vi) পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে ২য়, (vii) চাল, রসুন এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত চিনিজাতীয় ফসল উৎপাদনে ৩য়, (viii) জামের মতো ফল ও সুগন্ধি মসলায় ৪র্থ (ix) মসুর ডাল ও গ্রীষ্মকালীন ফলে ৬ষ্ঠ, (x) পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি ও নারিকেলের ছোবড়ায় ৭ম, (xi) চা ও কুমড়ায় ৮ম এবং (xii) আম, পেয়ারা, ফুলকপি ও ব্রকলি, মটরশুঁটি এবং পাখির খাদ্য উৎপাদনে ৯ম।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ১০০টি, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ২২টি ধানের জাত এই পর্যন্ত উদ্ভাবন করেন। ২০০৭ সালে ২.৭ কোটি মেট্রিকটন থেকে ২০১৮ সালে ৪ কোটি মেট্রিকটনে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালে ১ কোটি মেট্রিকটন থেকে ২০১৬ সালে ১.৫ কোটি মেট্রিকটনে সবজি উৎপাদন উন্নীত হয়।

শস্যবীজ উৎপাদনে ২০০৭ সালে ৭১,৭০৫ মেট্রিকটন থেকে ২০১৭ সালে ১,৩৬,৯৬১ মেট্রিকটনে উন্নীত হয়।  ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। ২০০৭ সালে দুধ উৎপাদন ০.২ কোটি টন থেকে ২০১৭ সালে ৯.৩ কোটি টনে উন্নীত হয়। গবাদিপশুর সংখ্যা ২০০৭ সালে ৪.৭৫ কোটি থেকে ২০১৮ সালে ৬.৪৭ কোটিতে উন্নীত হয়।

২০০৬ সালে মানুষ দিনে ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত, ২০১৯ সালে তা ৮৫ গ্রামে উন্নীত হয়। সাফল্যের আরও কারণ—(i) সেচ এলাকা ২০০৭ সালে ৫০ লাখ হেক্টর থেকে ২০১৭ সালে ৭০ লাখ হেক্টরে উন্নীত, (ii)২৫৪টি কৃষি তথ্যকেন্দ্র গঠন করা হয়, (iii) ২ কোটি ১০ লাখ কৃষক কৃষিসহায়ক কার্ড পেয়েছেন, (iv) ৩৩,৪৩২ জন ২৫৬০ কোটি টাকা কৃষি উদ্যোক্তা ঋণ পেয়েছেন এবং (v) ৪১,৫০০ জন কৃষক, ২৮৮৬ জন উদ্যোক্তা, ৭০০ এনজিও কর্মী, ৩৮০ ব্যাংকার ও ২৮৪ জন সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

লেখক: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজবাড়ী সরকারি কলেজ।