অমিত দত্ত

শ্রম অধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য স্যাংশনের বিষয়ে সতর্ক করেছে ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়া এক চিঠিতে সতর্কতা জানানো হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গত সাড়ে তিন দশক ধরে ইরাক থেকে শুরু করে সিরিয়া, রাশিয়া ও চীন আফ্রিকার আফ্রিকার অনেক দেশগুলোতেও স্যাংশন দেওয়া হয়েছে।

এই স্যাংশন অর্থনীতিতে আশংকার কথা প্রকাশ করে এটাও  অনেকাংশে সত্য। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের তিন মাস আগে জারি ভিসা নীতি জারি করেছে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র। বিশ্বের বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন যে, নিজেদের স্বার্থে এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে তারা এটা করেছে।

ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে এই স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা। বাণিজ্যের বিধিনিষেধ এমন একটি ক্ষতিকর প্রক্রিয়া যা একটি দেশকে মুহূর্তেই অস্থির করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের মতো আমদানি-নির্ভর দেশের ক্ষেত্রে এটি বেশি সমস্যার। কারণ রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে আমদানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে এর সাথে সাথে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যরে যে প্রবৃদ্ধি  আছে তাও হুমবকর মধ্যে পড়তে পারে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ  যেমন সর্বাধিক অর্থনৈতিক ক্ষতি ঘটাতে পারে, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক ভাবেও এর প্রবনতা নানাবিধ মাত্রা ডোগ করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে  বাংলাদেশে এফডিআই স্টক দাঁড়িয়েছে ২১ দশমকি ৮২৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে তিনটি দেশ। এগলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও যুক্তরাজ্য। এ তিন দেশেরই বাংলাদেশে বিনিয়োগ মোট এফডিআইয়ের ৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের ১৮ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৪৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয় গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে। দেশটির শেভরন একক কোম্পানি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের গ্যাস খাতে বিনিয়োগ করেছে ২ দশমিক ৮১৫ বিলিয়ন ডলারের, যা দেশটির মোট বিনিয়োগের ৭১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এছাড়া বিমা খাতে ২৭১ মিলিয়ন ডলার, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২২৯ মিলিয়ন ডলার, ব্যাংক খাতে ২১৩ মিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ খাতে ১৫১ মিলিয়ন ডলার ও টেক্সটাইল খাতে ১৪৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য।

এই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিনিয়োগের অনেক বড় বাজার । সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল সহজলভ্য হওয়ার কারনে এবং সঠিক কর্মপরিবেশ নির্ধারিত হলে অদূর ভবিষ্যতে এই বিনয়োগ বাড়বে ছাড়া কমবে না। মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিনিধিরা – কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও মোটরগাড়ি শিল্পেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। তবে এটা সত্য যে, বাংলাদেশের ও পোষাক শিল্পের বড় ক্রেতা হল যুক্তরাষ্ট্র।

বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের শ্রমিক অসন্তোষ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র কথা বলেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমাস সরকার ও শ্রমের মূল্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া ও কর্মপরিবেশ ঠিক রাখার জন্য নানাবিধ কাজ করছে।

ইতোমধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এখন প্রশ্ন হল তারপর ও বাংলাদেশ পোশাক শিল্প বা অন্য কোন ইস্যুতে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা দিবে কিনা?

একটু পিছন ফিরে যদি দেখা যায়, আজকে যে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞার সংস্কৃতি চালু হয়েছে, এর শুরু হয়েছিল নব্বই এর  দশকে এই যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই। বিশ্ব জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘স্যাংশন পলিটিক্স’ যা এখন ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জর্জ লোপেজ এই স্যাংশন পলিটিক্সকে নব্বইয়ের  দশককে ‘স্যাংশন ডিকেডস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের কথা বলে যে স্যাংশন দেওয়ার কথা বলা হলেও এর সাথে  ভূ-রাজনৈতিক বা অন্য কোন রাজনৈতিক ও  অর্থনৈতিক কোন আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তাছাড়া বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ মার্কিন বিনিয়োগ রয়েছে তার অবস্থা কি হবে সে বিষয়টিও তাদের তরফ থেকে ভাববার বিষয় রয়েছে। 

আশার কথা হল, বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের কয়েক ডজন ব্যক্তির ওপর নতুন করে স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, তবে এই তালিকায় বাংলাদেশ বা দেশের কোনো ব্যক্তির নাম নেই।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, নির্বাচন ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা খাত মার্কিন নীতির কষাঘাতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা আছে, এমন অবস্থায় নতুন শ্রম নীতির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার দরকার আছে।

পাশাপাশি কূটনৈতিক ভাবে আলাপ আলোচনার ও প্রয়োজন রয়েছে। তারপর ও যদি কোন কারনে স্যাংশন দেওয়ার কথা তারা চিন্তা করে তাদের নিজেদের বিনিয়োগ ও যে হুমকির মধ্যে পড়তে পারে সে প্রক্ষিতেও আলোচনার দিকে মত দিয়েছেন অনেক বিশ্লেষক।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, টার্গেট করা দেশের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক প্রভাবগুলি তাদের বাণিজ্যের শর্তাবলীতে প্রতিফলিত হয়, যা একতরফা থেকে বহুপাক্ষিক নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য দেশে মূলধন ফেরতের হার বাড়ায় সে ক্ষেত্রে এই তাদের বিনিয়োগ ও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

সবার স্বার্থে, দেশ ও সকলের মঙ্গলের জন্য বিবাদমান নীতিগুলোকে কিভাবে আরো বেশী সমাধান করা যায় সেভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করা সম্ভবপর হবে বলেই অনেকের বিশ্বাস। তাহলে বাংলাদেশের অর্থণীতি যেমন তরান্বিত হবে ও বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের  অর্থণীতিও অনেকদুর এগিয়ে  যাবে।

লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।