নিজের ক্যারিয়ারে বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। পূর্ণ নাম আসাদুজ্জামান মোহাম্মদ রাইসুল ইসলাম। যিনি প্রতিটি চরিত্রে ভিন্ন ভিন্ন আসাদ হয়ে দেখা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ বলতে পারবে না সব চরিত্রেই ঘুরেফিরে তিনি একই আসাদ হিসেবে দেখা দিয়েছেন। অবাক করার বিষয়, এরকম একজন বর্ণাঢ্য অভিনেতাও বর্তমানে নতুন চরিত্র খুঁজে পাওয়ার সংকটে আছেন। প্রতীক্ষায় আছেন আবার একটি নতুন চরিত্রে অভিনয়ের।

তার মতো অভিনেতাকে কেন নতুন চরিত্রের অপেক্ষায় থাকতে হবে? তবে কি নির্মাতারাই এমন নতুন চরিত্র সৃষ্টি করতে পারছেন না যাতে তিনি নিখুঁত হবেন? সম্প্রতি নতুন নির্মাতা বা পরিচালকরা বেশ ভালো গল্পের ভালো সিনেমা উপহার দিতে পারলেও এমন চরিত্র দিতে পারছেন না যে চরিত্র নিয়ে আলোচনা চলবে যুগ যুগ।

রাইসুল ইসলাম আসাদের সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’। তবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই সিনেমাটিতে চরিত্র হিসেবে তার মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এতটাই সংক্ষিপ্ত যে, তাতে এ মজলুম জননেতাকে হুবহু খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে গল্প ও পরিচালকের সীমাবদ্ধতার কারণেও নিখুঁত চরিত্র হিসেবে তাকে সেইসব চরিত্রের মতো খুঁজে না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন পাওয়া গেছে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ঘুড্ডি সিনেমার ‘মোহাব্বত আলী’ চরিত্রে কিংবা গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র ‘কুবের’ চরিত্রে বা শেখ নিয়ামত আলীর ‘অন্য জীবন’ এর ‘পান্তব মিয়া’ চরিত্রে। তাই যায়যায়দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা আসাদ মনের দুঃখেই হয়তো বলেন, ‘আমি কিছুই করি নি। যা করেছেন সবই আমার পরিচালক। আমি শুধু তার কথামতোই অভিনয়টুকু করে গেছি। আমি শুধু একজন পরিচালকের ক্রীড়নক হিসেবে যতটুকু সম্ভব কাজ করে গেছি।’ ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটিতেও তার অভিনয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে একই কথা বলেছেন তিনি। অর্থাৎ অভিনয়ের ভালো-মন্দ যা-ই হয় সব দায় তিনি এভাবে পরিচাকের কাঁধেই ছেড়ে দেন।

সিনেমাটিতে তার চরিত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ছবিটির নাম কি? ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’। কাজেই ছবিটিতে অন্যসব চরিত্রের গুরুত্ব থাকবে কেন? ছবিটির স্ক্রিপ্ট যেভাবে তৈরি হয়েছে পরিচালক যেভাবে চেয়েছেন- সেভাবেই কাজ হয়েছে। আমিও সেভাবেই ক্যারেক্টারটা করেছি। আর আমি ছবির খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশে ক্যারেক্টার করেছি। খুব ক্ষুদ্র একটা অংশে অভিনয় করেছি, আমি তো মূল কাজ করি নি- এর বেশি তো কিছু বলা যাবে না।’

বোঝাই যাচ্ছে, চরিত্রটি নিয়ে তার অভিনয় জীবনের সেরা চরিত্রগুলোর তুল্যমূল্য বিচারে তৃপ্ত নন। যদিও তিনি আরও অনেক ‘ক্ষুদ্র’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে সেগুলো বাস্তবেও ‘ক্ষুদ্র’ই ছিল। কিন্তু মজলুম জননেতা হিসেবে ভাসানী যতটা ব্যাপ্তি জুড়ে ক্যারেক্টার হয়েছেন সেটা মোটেও ‘ক্ষুদ্র’ নয়- তাই তো সেই ক্যারেক্টারের কিছুই করতে পারলেন আসাদ। কেন পারেননি সব দায় পরিচালকের ওপর চাপিয়ে অভিনেতা আসাদ বলেন, ‘এমনিতে বলতে পারি, আমি যা করেছি, বোম্বেতে গিয়ে কাজ করেছি, ঢাকায় কিছুদিন কাজ করেছি। পরিচালক যেভাবে চেয়েছেন আমি সেভাবেই ক্যারেক্টারটা করেছি। স্ক্রিপ্ট যেভাবে তৈরি হয়েছে পরিচালক যেভাবে চেয়েছেন- সেভাবেই কাজ হয়েছে। আর আমি ছবির খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশে ক্যারেক্টার করেছি। খুব ক্ষুদ্র একটা অংশে অভিনয় করেছি, আমি তো মূল কাজ করি নি- এর বেশি তো কিছু বলা যাবে না।’

সম্ভবত অভিনেতা আসাদ তার ক্যারিয়ারে এই প্রথম উপমহাদেশের একটি বহু বর্ণাঢ্য রাজনীতিকের ওপর কাজ করেও তেমন বর্ণিল চরিত্ররূপে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। ছবির কাহিনী যেমন, পরিচালকের পরিচালনা যেমন হয়েছে- সে কারণে।

তাই যেমন ক্যারেক্টার তেমন কাজ পাওয়াতেই লালন সাঁইকে নিয়ে করা তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করতে পেরেছেন পরম তৃপ্তির সঙ্গে তিনি। কিংবা ‘লালসালু’ সিনেমার মূল চরিত্র ‘মজিদ’ চরিত্রে। তাই তিনি ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় নিজের অভিনয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমি তো মূল কাজ করিনি’। অর্থাৎ এই প্রথম যতবড় নাম ততবড় চরিত্রে পারফর্ম করতে পারেননি তিনি। তাই তো পরিচালক মালেক আফসারী বলেন, ‘একজন অভিনয় শিল্পী তো কাদামাটির পুতুল বিশেষ। পরিচালক একদলা কাদামাটিকে যেভাবে রূপ দেবেন একজন অভিনয় শিল্পীও সেভাবেই আকার নেবেন।’

একটি সিনেমায় কাহিনী বা গল্পের ভূমিকা অপরিসীম। এ কারণেই একটি কাহিনী বা গল্পই সিনেমার সুপারস্টার। গল্পের ভূমিকা অনুযায়ী যার যেমন চরিত্র একজন অভিনেতা সেরকমই অভিনয় করতে পারেন। এর বেশি বা কম পারেন না। তারপরেও বাস্তবে, উপন্যাসে বা গল্পে একটি চরিত্র আসলেই যেমন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে তেমন দাবি পূরণ না হলে একজন অভিনেতা তাতে অভিনয় করতে পারেন? একজন অভিনয় শিল্পী কি শুধুই কাদামাটির পুতুল? তারও কিছু স্বাধীনতা থাকবে না বাস্তবে চরিত্রটি যেমন তেমনভাবে চিন্তা করার? নয়তো একজন অভিনয় শিল্পী পুতুলের নিখুঁত রূপটি ফুটিয়ে তুলবেন কীভাবে।

যায়যায়দিনের পক্ষে চরিত্র অনুযায়ী চরিত্রের চিন্তা করা সম্পর্কে জানতে অভিনেতা আসাদকে যখন বলা হলো সময়ের প্রেক্ষাপটে ভাসানীকে যেভাবে পাওয়া যায় সেই ব্যাপ্তিতে এখানে একজন আসাদকে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, যেমন পাওয়া যায় ‘মওলানা ভাসানী’ স্বভাবের প্রকাণ্ড চরিত্রে? তখন এ অভিনেতা বলেন, ‘না, না- একে ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে দেখলে কোনো লাভ হবে না। এখানে ঐসবের কোনো তুলনা-মুলনা করাই যাবে না। ছবিটির স্ক্রিপ্ট যেভাবে তৈরি হয়েছে, পরিচালক যেভাবে চেয়েছেন- সেভাবেই কাজ হয়েছে।’

তাই স্ক্রিপ্ট যেভাবে তৈরি হয়েছে, পরিচালকও সেভাবে চেয়েছেন বলেই উত্তাল প্রমত্তা পদ্মা নদীর বুকে শক্ত হাতে নৌকার বৈঠা ধরতে পারছে একজন অভিনেতা আসাদ; যাকে পাওয়া যায় জেলেপাড়ার সেই সংগ্রামী জেলে কুবেরের সঙ্গে প্রথাবিরোধী তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে- যাতে বাস্তবের সঙ্গে সেই ‘চলো না ঘুরে আসি’ ছেলেটির জীবনধারার পার্থক্য অনেক। আবার কুসংস্কারচ্ছন্ন অন্ধবিশ্বাসী ‘মজিদ’ থেকে লালন সাঁই- এই বৈচিত্রকে যিনি ধারণ করতে পারেন নিজের মধ্যে, স্বার্থকভাবে রূপায়িত করতে পারেন পর্দায় আর স্থায়ী আসন করে নেন দর্শক হৃদয়ে, তিনিই তো সার্থক অভিনেতা। অভিনেতা আসাদের ভাষায়, যদি তার অভিনয় একজন পরিচালক, ছবির স্ক্রিপ্ট বা কাহিনীর তুল্যমূল্য বিচারে সেরকম হয়।

বাংলাদেশের যে কয়েকজন মুষ্ঠিমেয় অভিনয়শিল্পী মঞ্চ, বেতার, টিভি ও চলচ্চিত্রে সমানভাবে সফল, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে রাইসুল ইসলাম আসাদ প্রথম সারিতে থাকবেন। কিন্তু তার মতো অভিনেতাকেও কেন একটি চরিত্রের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হবে? কেন তাকে এমন চরিত্রেও অভিনয় করতে হবে যেখানে একজন রাইসুল ইসলাম আসাদকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না!