প্রফেসর ড. মো: মনিরুল ইসলাম (সোহাগ)

মানবাধিকার শব্দটি শাশ্বত ও সর্বজনীন। বর্তমান সময়ে এ দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম মানবাধিকার। অথচ শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা, সুবিচার এবং সব নাগরিকের আইনের আশ্রয় পাওয়ার সমানাধিকার নিশ্চিত করেন। আজ যখন বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কিছু মহলের মাতম উঠেছে তখন ২০০১ সালের অক্টোবরের কথা খুব মনে পড়ল। ঠিক ঐ সময়ে ‘আয়নাঘর’ নামে এক প্রামাণ্যচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল। উক্ত প্রামাণ্যচিত্রে একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী ব্যক্তি যেন হিন্দি ছবির নায়ক। চোখ বাঁধা অবস্থায় অবলীলায় তিনি বলে গেলেন তাঁকে কোথায় কীভাবে কোন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আরেকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা বুক চিতিয়ে বললেন, বাবরের (লুৎফুজ্জামান বাবর) সময় কীভাবে তাঁকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রাজশাহী, চট্টগ্রামে তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড করেছেন, এমন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিলেন। কসম খেয়ে বললেন বিনা অপরাধে কাউকে তিনি হত্যা করেননি। বাহঃ কী অদ্ভুত! বিএনপি-জামাত সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তাহলে আদালত, আইন, বিচার ছাড়াই হত্যার নির্দেশ দিতেন? এ আয়নাঘর প্রচারের পর বিএনপি-জামাত নেতারা ‘আয়নাঘর’‘আয়নাঘর’বলে জিকির শুরু করেছিলেন। আহারে কী কান্ড! সব দেখেশুনে মনে হলো, হায় মানবাধিকার! তুমি আসলে কার?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং এরপর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধ করা মাধ্যমে। এরপর এ দেশে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল ১৯৭৭ সালে ১৪০০ সেনা ও বিমান বাহিনীর অফিসারদেরকে বিনাবিচারে হত্যার মাধ্যমে। এমনকি শুধু নামের মিল থাকায় মানুষকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় সে চিৎকার করে বলেছিল- আমি সেই ব্যক্তি নই, আমি সেই ব্যক্তি নই, কিন্তু কে শোনে কার কথা। এমনও ঘটেছিল, ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পরে রায় হয়েছে। এভাবে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সূচনা শুরু হয় এই স্বাধীন বংলাদেশে।

২০০৮-এ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী অঙ্গীকারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ঘোষণা দিয়েছিল। সে সময় খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না। কিন্তু শেখ হাসিনা যা বলেন, তা করেন। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অসীম সাহসের সঙ্গে শুরু করেছিলেন। বিচারের সময় বাংলাদেশে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে শুরু হয় মায়াকান্না। ১৯৭৫-এর পর থেকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি বিত্ত-বৈভবে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। বিচার শুরু হলেই বিপুল বিত্তের মালিক এই গোষ্ঠী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনকে ভাড়া করে। যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এরাই প্রথম বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন তোলে। তখন থেকেই এই দেশে ‘মানবাধিকার ‘  ইস্যু লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়।

২০২২ সালের আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশে এসেই একটি পাঁচ তারকা হোটেলে তাদের পুর্ব পরিচিত ও অনুসারী ২০ ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেছিল। ওই বৈঠকের আগেই ‘নেত্র নিউজ’ প্রকাশ করে সেই ‘আয়নাঘর’। ঐ আমন্ত্রিত ২০ জন আয়নাঘরের ভাষায় কথা বলেন। মিশেল বিদায়ের কালে প্রচ্ছন্নভাবে জানিয়ে গেলেন, তাঁদের কথাই তিনি বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু সরকার বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর সাথে মিশেল কেন বৈঠক করেননি? এটা কি অদক্ষতা নাকি ষড়যন্ত্রের অংশ? শোকাবহ আগস্টের এই বৈঠক নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন রয়েছে। জাতীয় শোক দিবসে এ রকম একটি বৈঠকের আয়োজন করা হলো কেন? ওই বৈঠকে কি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল? ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা কি পালন করা হয়েছিল? জাতীয় শোক দিবসে মানবাধিকার নিয়ে আলাপে যদি ১৯৭৫-এর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ না আসে, তাহলে বুঝতে হবে ওই বৈঠক ছিল উদ্দেশ্যপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট। ওই বৈঠকের পেছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র।

যখন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছিল, চার লক্ষাধিক নারীকে অসম্মান করা হয়েছিল, ১৪ই ডিসেম্বর দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছিল এবং ২৫ শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে যে গনহত্যা চালিয়েছিল, তখন কোথায় ছিলেন মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা? ১৯৭৫ সালে যখন জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার? একই বছরে আরও চারজন জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয় জেলখানায়, তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার? জাতির পিতার হত্যার বিচার বন্ধ করে যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হলো তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ১৫ আগস্টের খুনিদের প্রেতাত্মারাই আজকের মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা। কর্নেল তাহের হত্যাকান্ড, বিনা বিচারে হাজার হাজার সৈনিককে কারাগারে হত্যা করা হলো। তখন কোথায় ছিলেন আমাদের মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা? ১৯৭৫-১৯৯৬ পর্যন্ত গুম-হত্যাকান্ড ঘটেছে প্রতিনিয়ত। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে যে তান্ডব চালাল তার আঁচ করা যাবে সে-সময়কার সংবাদপত্রগুলো থেকে; ফেনী ও সোনাগাজীতে বিএনপি সন্ত্রাসীদের হাতে দুই আওয়ামী লীগ কর্মী খুন (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৪ অক্টোবর ২০০১), নৌকায় ভোট দেওয়ায় মিরপুরে বিএনপি ক্যাডারদের তান্ডব (দৈনিক সংবাদ, ৪ অক্টোবর ২০০১), রাজধানীতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা (দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ অক্টোবর ২০০১), মাদারীপুরে ছাত্রলীগ নেতার হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে বিএনপি কর্মীরা (দৈনিক প্রথম আলো, ১১ অক্টোবর ২০০১), ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের কান্ড। সিরাজগঞ্জে বাড়িতে চড়াও হয়ে সংখ্যালঘু স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে ধর্ষণ (দৈনিক প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০০১)- এ রকম অসংখ্য শিরোনাম খোজ করলেই পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক নিপীড়ন, প্রতিপক্ষকে হত্যা-ধর্ষণ এসব না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে অপারেশন ক্লিনহার্টকে কী বলবেন? অপারেশন ক্লিনহার্টে মারা গেছেন ৫৮ জন। ২০ হাজারের বেশি মানুষ নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৮৬ দিনব্যাপী এ অভিযান চলার পর ‘দায়মুক্তির’ অধ্যাদেশ জারি করা হলো। এর মাধ্যমে ২০০২-এর ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর সব হত্যা ও নির্যাতনের বিচার রোধ করে দায়মুক্তি দেওয়া হলো। তখন মানবাধিকার নিয়ে কাউকে হাহাকার করতে দেখিনি। জাতিসংঘকে কোনো সুপারিশ দিতেও শুনিনি। যুক্তরাষ্ট্রও কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।

ঠিক একইভাবে ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের সিনেমা হলগুলোতে বোমা হামলায় ২৭ জন নিরীহ মানুষ হত্যাসহ আহত ২ শতাধিক, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেট হামলায় ২৪ জন নিহতসহ আহত ৫ শতাধিক, ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর চট্রগ্রাম ও গাজীপুরের আদালতে বোমা হামলায় ৮ আইনজীবি ও ২ পুলিশ হত্যা এবং ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলায় ৩ জন হত্যাসহ আহত ৩ শতাধিক, ২০০৬ সালে কৃষির জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চাওয়ায় দেশব্যাপী ২৪ জন কৃষককে গুলি করে হত্যাসহ আরও কতো কি। তখন কোথায় ছিলেন আমাদের মানবাধিকারের বাশিওয়ালারা?

যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর মৃত্যুদন্ডাদেশ দিলে জামায়াত-শিবির ৫০ টিরও বেশি মন্দির ভাংচুর, ১৫০০ এর বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ধ্বংস করাসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ ধ্বংস করে। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে দলটি প্রায় ৪১৯ টি পৃথক ঘটনায় ১৫ জন পুলিশ সদস্য সহ হত্যা করে ৪৯২ জন নিরপরাধ মানুষকে। এ সকল অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ ও নাশকতামূলক কর্মকান্ডে আহত হয় প্রায় আড়াই হাজারের মত মানুষ। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে বিএনপি-জামাত দেখায় তাদের ভয়ংকরতম রূপটিকে। এ সময় তারা আগুন ধরিয়ে দেয় সারাদেশের প্রায় ৫৮২ টি ভোটকেন্দ্রে, শত শত যানবাহনে, রাস্তার পার্শ্ববর্তী বৃক্ষরাজিতে, এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে। নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় যেনে তারা পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে মারে বহু নিরপরাধ সাধারণ জনগণকে। অগ্নিদগ্ধ অসহায় মানুষদের কান্নার আহাজারিতে প্রকম্পিত হয়েছিল সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালগুলো। নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার সহ এই সন্ত্রাসী জোট হত্যা করে ২৬ জন মানুষকে। একবছর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি যখন আওয়ামী লীগ সে মেয়াদ কালের তাদের প্রথম বর্ষ উদযাপন করছিল, সেদিনও আবার মাথা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আগুন সন্ত্রাসেরা। সেসময় ২ হাজার ৯০৩টি বাস-ট্রাক, ১৮টি ট্রেন, ৮ টি যাত্রীবাহী লঞ্চ, ৭ টি ভূমি অফিসসহ ৭০ টি সরকারি অফিসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে সন্ত্রাসী সংগঠনটি। এসব ঘটনায় নিহত হয় ২৩১ জন মানুষ এবং গুরুতর আহত হয় ১ হাজার ২০০ মানুষ। অদ্যাবধি সেই আগুন-সন্ত্রাসের কার্যক্রম চলমান। বিগত ২৮ অক্টোবর  হতে ৬ ডিসেম্বর ২০২৩ অবধি বিএনপি-জামাত জোট ২৫৬টি গনপরিবহনে অগিসংযোগের মাধ্যমে পুলিশ ও ঘুমন্ত শ্রমিককে হত্যা করেছে। তখনতো মানবাধিকার নিয়ে কাউকে হাহাকার করতে দেখিনি। তখন কোথায় ছিলেন আমাদের মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা?

এখন বিএনপি-জামাত ও কথিত সুশীলসমাজ যখন মানবাধিকারের কথা বলেন তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। ২০০১-২০০৬ এবং ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশে যা করেছে তা অন্য দেশে হলে তদন্ত হতো। বিচার হতো। দুর্ভাগ্য আমাদের। মানবতার বিরুদ্ধে এসব অপরাধ ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা’ হিসেবে পার পেয়ে গেছে। এখন এই সুশীলসমাজের প্রধান ইস্যু হচ্ছে মানবাধিকার। কদিন তাঁরা অর্থনীতি গেল বলে কোরাস তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁদের অভিভাবক বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ যখন বলল, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট নেই। ঠিক পথেই আছে অর্থনীতি, তখন তাঁরা অর্থনীতি থেকে আবারও মানবাধিকারে মনোনিবেশ করলেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দেশে হাতে গোনা ২০-২৫ জন সুশীল মানুষ সব বিষয়ে সরকারের দোষ খুঁজতে ১৫ বছর ধরে দুরবীন নিয়ে ঘুরছেন। যাঁরা পদ্মা সেতু হবে না বলেছিলেন, যাঁরা বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পাবে না বলে জ্যোতিষী হয়েছিলেন, যাঁরা করোনার সময় বাংলাদেশে মহামারি হবে বলে, অর্থনীতি ধ্বংস, বাংলাদেশ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা বলে মুচকি হেসেছিলেন, তাঁরাই এখন মানবাধিকারের দোকান খুলে বসেছেন। কেন? শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য? কিন্তু শেখ হাসিনাকে পরাজিত করতে গিয়ে তো তাঁরা দেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কি এতই ভয়াবহ?

অথচ এসবের বিপরীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। ২০০৯ সালে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে কমিশন প্রতিষ্ঠা করে এই সরকার। ইতোমধ্যে কমিশনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে বর্তমানে কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শৈশব বা কৈশোর থেকেই শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘মানবাধিকার কোর্স’ চালু করেছে। তাছাড়া, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ প্রতিরোধে কমিশনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো “ন্যাশনাল ইনকোয়ারি কমিটি”করা হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় বিশ্বদরবারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বা ‘মানবতার মা’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে লাখ লাখ নির্যাতিত মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। এ ছিল মানবাধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের একান্ত প্রচেষ্টার ফলে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৩। বর্তমানে ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ১২৯তম অবস্থানে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারের কাজ করে যাচ্ছে। ২০২৩-২০২৫ মেয়াদের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউএনএইচআরসি)- এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন- “আমাদের সরকারের আমলেই জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশ ৪ বার সদস্য নির্বাচিত হয়েছে । ফলশ্রুতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং প্রচারে বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং অঙ্গীকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সস্প্রদায়ের স্বীকৃতির সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়াও এটি দেশে এবং বিদেশে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছু ব্যক্তির দেওয়া মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করার হীন উদ্দেশ্যকেও মিথ্যা প্রমাণ করে”।

তাহলে মানবাধিকার কি শুধু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য অস্ত্র? এ সরকার এবং বাংলাদেশকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যেই মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কতিপয় সুশীলসমাজ ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা মুখ দিয়ে বুলি আওড়াচ্ছে। এদের লক্ষ্য দিবালোকের স্পষ্ট যে, আগামী দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরা সেনাবাহিনী সম্পর্কে আরও ভয়ংকর এবং অবিশ্বাস্য মিথ্যাচার করবে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় সেটাই এ ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত ধাপ। তারা যে এই ষড়যন্ত্রে অনেক দূর এগিয়েছে, মিশেলের সংবাদ সম্মেলন তার একটা প্রমাণ। আগামী নির্বাচন যেন না হয় সেজন্যই পর্দার আড়ালে নানা ধরনের খেলা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে কিছু নীতিগত বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে একটি হলো সংবিধানে ৭(ক) যুক্ত করা। যার মাধ্যমে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের পথ তিনি চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। আরেকটি নীরব বিপ্লব, সেটি হলো সেনাবাহিনীকে একটি নিরপেক্ষ ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতির হাতিয়ার হওয়ার প্রবণতা থেকে দূরে রেখেছেন। এ কারণেই সেনাবাহিনী এখন দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে নিজেদের দূরে রাখে। এখানেই কথিত সুশীলসমাজ ও মানবাধিকার ফেরিওয়ালাদের যত রাগ এবং ক্ষোভ। বাংলাদেশের মানুষ এখন এগিয়ে যাওয়ার পথে, তারা শুধু স্বপ্ন দেখে উন্নত এক ভবিষ্যতের। যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। এ যুদ্ধে শেখ হাসিনাকে জিততেই হবে-এ দেশের মানুষের জন্য এবং ‘বাংলাদেশ’  নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য।

লেখক: প্রক্টর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।