সংবাদ ভাষ্য
মাত্র চার সপ্তাহ আগে ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মাহফুজ আনাম লিখেছিলেন আমরা সত্যি কি ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি? সেখানে তিনি বলেছিলেন নির্বাচন নিয়ে পরিবেশ ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা, ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানা খাতে অচলাবস্থা সৃষ্টির উল্লেখ করে তিনি এর জন্যে সরকারকে বহুলাংশে দায়ী করছিলেন। সেই লেখায় নানা তথ্য সূত্র ব্যবহার তিনি নির্বাচন আয়োজনে সরকারের ব্যার্থতা চিহ্নিত করেন। সেখানে তিনি বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে না পারার নানা দুর্বলতার কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে বলেই ফেলেন, সরকারি দলের নেতারা দায়িত্বহীন? তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের কোনো প্রস্তুতিই নিচ্ছে না।
এর মধ্যে চার সপ্তাহ কেটে গেছে। নির্বাচনে আসার সব পথই প্রসস্ত হয়েছে বিএনপির সামনে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের দূত তাদের সংলাপে বসার আহবান জানিয়েছে। তারা কোন সাড়া দেননি। তাদের নির্বাচনে আসার জন্যে তফসিল পেছানোর ইঙ্গিতও দেয় সরকার। কিন্তু তত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। নানা কারণে সুষ্টু নির্বাচন নিয়ে বিদেশি বন্ধুরা সবসময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঠিকই। কিন্তু কেউ কখনও এই অজনপ্রিয় সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলেনি। কারণ কোন সুষ্ঠু গণতন্ত্রের দেশে এই পদ্ধতির নির্বাচন নেই। যে কারণে অনেকের ইচ্ছে থাকা সত্বেও তারা সরকারকে চাপও দিতে পারেননি। তাই সবাই এখন চেয়ে আছে সুষ্টু নির্বাচনের দিকে।
একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি এখন দেশের বেশিরভাগ মানুষের। সবাই একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন চায়। এরইমধ্যে দেশের সব রাজনৈতিক দলের ৩ ভাগের দুই ভাগ নির্বাচনে এসে গেছে। গাণিতিকভাব এখন নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাচ্ছে। কিন্তু দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনও নির্বাচনে নেই। এরকম একটি অবস্থায় গত ৮ই নভেম্বর এই মাহফুজ আনাম লিখলেন, “বিএনপি কি তার কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশার সম্মান রাখছে” সারাদেশের সচেতন মানুষের কাছে লেখাটি আলোচিত হচ্ছে। সন্দেহ নেই সাংবাদিকতায় যারা রাজনীতি বিশ্লেষণ করেন, মাহফুজ আনাম তাদের অন্যতম।
লেখার শুরুতে মাহফুজ আনাম বলেন,বিএনপি শুধু হরতাল ও অবরোধের ডাক দিচ্ছে, যা কেউ মানছে না। বিএনপি অফিসের অচলাবস্থা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, গত ২৭ নভেম্বর বিকেলে দেখা যায়, বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের কলাপসিবল গেট দিয়ে একটি চেয়ারে কিছু সংবাদপত্র পড়ে আছে। টেবিল ও এর চারপাশে ধুলার আস্তর। বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দলের শত শত নেতাকর্মী কারাগারে। হাজারো নেতাকর্মীর নামে মামলা। লাখও নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বিএনপি কি তার দলীয় কর্মী, কিংবা বর্তমান সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না।
বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি লেখেন, বিএনপি দলের সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নাকি নিজেরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার ওপর চাপিয়ে দিলো? কিছু মানুষ সরকার পরিবর্তন চায়। কিন্তু বিএনপি কি সেই পরিবর্তন আনতে নিবীড়ভাবে কাজ করলো? যে ধুলোর আস্তর পড়েছে বিএনপি অফিসে সেই আস্তর আসলে পড়ছে গোটা দলটির ওপর। যদিও এরই মধ্যে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন ভোল পাল্টেছেন মাহফুজ আনাম। কিন্তু পুরো লেখায় তার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি কী ভুল করলো। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে আমাদের সার্বিক রাজনীতি চর্চা এই মুহূর্তে যে পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে তিনি লেখাটি শুরু করেছেন। এটি আসলেই সত্যের দাবি।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরই বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। একইসঙ্গে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানায়। এই দাবিতে ২০২২ সালে দলটি বিভাগীয় পর্যায়ে সমন্বয় করে বড় আকারের জনসমাবেশের আয়োজন করে। কিন্তু, সরকারের প্রতিক্রিয়া ঠিক কতটা কঠোর হতে পারে, সেটা সম্ভবত তারা ঠিকঠাক অনুমান করতে পারেনি। এমনকি সরকার কঠোর হলে তাদের করণীয় কী হবে, সেটাও সম্ভবত তারা হিসাব করেনি।
খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে মাহফুজ আনাম লেখেন, আর এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কারযে বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য, অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সেটাই প্রকাশ পায়। এই চাওয়া অগণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামেনি। গত বছর বিশাল জনসমর্থনের বীজ বপন করতে পারলেও এ বছর সেখান থেকে সাফল্যের কোনো ফসল ঘরে তুলতে পারেনি । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি জানানো হলে এর প্রতিক্রিয়া যে কঠোর কিছু হবে, তা অবধারিতই ছিল। কিন্তু কঠোর পরিস্থিতি এলে কীভাবে টিকে থাকা যাবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
মাহফুজ আনাম লেখেন, সব বিকল্প আলোচনার পথ রুদ্ধ করে বিএনপি সবচয়ে বড় ভুল করেছে। বিএনপি যে ‘বাইরের চাপ’র ভরসায় ছিল, সেখান থেকেও তারা পুরোপুরি হতাশ হয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি বলাও হয়, যে আওয়ামী লীগ কখনোই চায়নি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। তাহলে একথাও বলতে হবে বিএনপিও কখনোই টের পায়নি যে তাদের এই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত, সরকারকেই সহায়তা করছে। তিনি পরিস্কার বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ছিল তাদের ভুলের শুরু। ওই নির্বাচন তারা যদি বর্জন না করত, তাহলে খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে অবস্থান হারাতেন না। বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পারলেও, সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারত। বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াও তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়ার মামলাগুলো লড়তে বাড়তি সুবিধা পেতেন।
এবার ধরে বিএনপির দ্বিতীয় বারের মত নির্বাচন বয়কট করলো। এই অঞ্চলে তো বটেই, সম্ভবত কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই কোনো রাজনৈতিক দল এক দশকের মধ্যে দুটি নির্বাচন বয়কট করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বিএনপির এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মাহফুজ আনাম মন্তব্য করেন, দেখে মনে হচ্ছে যে, বিএনপি মনে করে, নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা না পেলে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো কারণই নেই। এমন চিন্তা একটি মারাত্মক ভুল এবং অগণতান্ত্রিক। কারণ শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকার প্রয়োজনগুলো তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। বিএনপি এটা বিবেচনা করলো না যে তাদের নিজস্ব নীতি ও ভিশন প্রচারে শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে সংসদ।
বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে তাদের ৩০০ প্রার্থী নিজেদের পক্ষে প্রচার চালাতে পারতেন। এতে তাদের প্রতিপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহার, অপকর্ম ও দুর্নীতির চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারতেন। এই প্রচারে ক্ষমতাসীন দল খানিকটা হলেও জবাবদিহীর আওতায় আসত এবং বিএনপির প্রতি জনগণের সমর্থন জোরালো হতো। আর কিছু না হলেও বিএনপির নির্বাচনী প্রচারের কারণে ক্ষমতাসীন দল কিছুটা হলেও সংযত হতো। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও আসার আগ্রহ পেতেন, যা নিঃসন্দেহে আমাদের নির্বাচনের মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত।
১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের দিকে তাকিয়ে ছিল বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোন স্যাংশন দেয় কী না সেই দিকে। হায় এবার সেখানেও বাংলাদেশের নাম নেই। দেশে এখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী। বিএনপির কোন কথা বা রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। তাই প্রচারও নেই। তবে হরতাল অবরোধ নিয়ে তাদের নেতিবাচক খবর আছে। তাছাড়া গত ২৮শে অক্টোবর ২৮ জন সাংবাদিক মার যখাওয়ার পর তাদের খবর সংগ্রহেও বহু সাংবাদিক আগ্রহ হারিয়েছেন। টিভি টকশোতে পাল্টাপাল্টি কথা বলার যোগ্যতা হারিয়ে গাল ফুলিয়েছেন বিএনপি নেতারা। রাগ করে দুটি জনপ্রিয় টেলিভিশন বয়কট করেছে তারা। একদিকে প্রচার নেই, অন্যদিকে নির্বাচনে নেই, জনসংযোগে নেই। এরকম “নেই” এর মধ্যে থাকরে দলের কার্যালয়ে কতদিনের ধুলোর আস্তর জমবে? যদিও তা নিয়ে অবশ্য মাহফুজ আনাম সরাসরি কিছু লেখেননি।