উত্তরবঙ্গের মঙ্গা। এক সময় ভয়াবহ ছিল। আশ্বিন কার্তিক মাস এলেই এ অঞ্চলে শুরু হতো হাহাকার। কর্ম সংকটে খাদ্যের কস্টছিল প্রকট। কচু ঘেচু খেয়ে ছড়িয়ে পড়তো ডায়রিয়া। অনাহারে মানুষও মারা যেতো। আজ সেই উত্তরের মঙ্গা যেনো ইতিহাস।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেষ্টা প্রচেষ্টায় বদলে গিয়েছে উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবিকার চিত্র। নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার অসংখ্য পরিবারের জীবনযাত্রা পাল্টে গিয়েছে। অসংখ্য পরিবার খুঁজে পেয়েছে সুখের ঠিকানা।
এটি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র উত্তরবঙ্গের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ উত্তরা ইপেজেডের কারণে। নীলফামারী শহর থেকে প্রায় ৯ কিমি দূরে অবস্থিত উত্তরা ইপিজেড। এখানে বাণিজ্যিক প্লটের সংখ্যা ২০২টি যার প্রতিটির আয়তন ২ হাজার বর্গমিটার। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণের প্রথম পদক্ষেপে নীলফামারীর সংগলশী ও সোনারায় ইউনিয়নে ২১৩ দশমিক ৬৬ একর জায়গায় উত্তরা ইপিজেড স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০১ সালের ১ জুলাই নীলফামারী এসে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় চীনের একটি মাত্র সোয়েটার কো¤পানি দিয়ে উত্তরা ইউপিজেডের পথচলা শুরু হয়েছিল। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যখন এখানে এসে কারখানা স্থাপনের পথ খুঁজছিল তখনি সরকারের পট পরিবর্তনে তা থমকে গিয়েছিল। ২০০১ সালে ১০ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতায় এলে উত্তরা ইপিজেডকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অনেক রাজনৈতিক পেক্ষাপট পেরিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে নতুনরূপে উত্তরা ইপিজেড প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে পেতে শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড হতে রফতানি হয়েছে ৯৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৯৯৫.৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সমমূল্যের নানা পণ্য। বর্তমানে উত্তরা ইপিজেডে ২৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৩৫ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ১৫ হাজার দক্ষ শ্রমিক রফতানিমুখী পণ্য উৎপাদনে কাজ করছেন। যার অধিকাংশ হচ্ছে নারী শ্রমিকরা। এখানে উৎপাদিত বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন রকমারি পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। এই ইপিজেড প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এর রফতানির পরিমাণ এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখানে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০ কোটি টাকা আয় করেন। ব্যাপক কর্মযজ্ঞ মঙ্গাপীড়িত এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। দূর করেছে বেকারত্বের অভিশাপ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উত্তরা ইপিজেডে চশমা ও চশমার ফ্রেম, পুতুল (মডেল), উইগ, খেলনা, বাঁশের তৈরি কফিন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ব্যাগ, বেল্ট, পরচুলা প্রভৃতি সহ আরো অনেক পণ্য তৈরি হয়।
উত্তরা সোয়েটার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে চীনাদের তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশের শ্রমিকরা উন্নতমানের সোয়েটার উৎপাদন ও বাঁশের তৈরি কফিন এবং চামড়াজাত পণ্য বাজারজাত দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। বর্তমানে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হংকংভিত্তিক এভারগ্রিন প্রোডাক্ট ১০টি প্লট বরাদ্দ নিয়ে উৎপাদন করছে পরচুলা। ২০১৫ সালে সারাবিশ্বে সাড়ে তিন কোটি পরচুলা (উইগ) রফতানি করে এভারগ্রিন নামে হংকংভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান। আয় হয়েছে দেড় কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। কারখানায় কাজ করেন ১৫ হাজার শ্রমিক। ২০১৫ সালের পর একইভাবে তারা পরচুলা রফতানি করে যাচ্ছে বলে এবারও জানাল এই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা।
সনিক বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান মডেল (পুতুল) তৈরি করে জাপান, হংকং, ফ্রান্স, ইউরোপ, কোরিয়াসহ বিদেশের বাজারে সুনাম কুড়িয়েছে। কারখানাটিতে পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এছাড়া মরদেহ সংরক্ষণ বা দীর্ঘপথ মরদেহ বহন অথবা দাফনের কাজে ব্যবহৃত তিন ধরনের কফিন ইউরোপের বাজারে সুনাম অর্জন করেছে। ফলে এই কফিনই সমাদৃত হয়েছে ইউরোপের বাজারে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কফিনের বাজারও দখল করছে বাংলাদেশ। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই সব কফিন তৈরির কারিগররা হলেন নীলফামারীর অসহায় পরিবারের নারী-পুরুষ। কফিনগুলো স¤পূর্ণ এগ্রিকালচার বেস্ট হওয়ায় এর ৭৫ শতাংশ কাঁচামাল এ অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি কফিনের ওজন সর্বোচ্চ ২০ কেজি। তিন ধরনের কফিন তৈরি হচ্ছে ব্যাম্বু (বাঁশ) কফিন, সি গ্রাস (হোগলা) কফিন ও উইলো কফিন। বাঁশ ও হোগলা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত হয়। শুধু উইলো আমদানি করতে হয়। উইলো দেখতে প্রায় পাটখড়ির মতো। এটি পাটখড়ির মতো ভক্সগুর হলেও এটিকে পানিতে ভেজানোর পর বেতের মতো বাঁকানো যায়। ওই কফিনগুলো ভেজিটেবল ডাই ব্যবহার করে রং করা হয়। এখানেই যুক্তরাজ্যের ডেভিড হাউ শুরু করেছেন ওয়েসিস কফিনস নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদান দিয়ে কফিন তৈরি করে তা ইউরোপের বাজারে বিক্রির কাজ করে ওয়েসিস কফিনস। এটিতে সহায়তা করছে এল জেরি ও ফিয়ানার গড়া প্রতিষ্ঠান টিন্ডার ক্যাপিটাল। সঙ্গে যোগ দিয়েছে পানাপুর নামে যুক্তরাজ্যের আরেকটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের এই সংগ্রামে সঙ্গী হলেন বাংলাদেশের নীলফামারীর দরিদ্র নারী-পুরুষরাও। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির কফিন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জেসি এ্যাটকিনসনের সঙ্গে চুক্তি হয় ওয়েসিস কফিনসের। ফলে বাংলাদেশের নীলফামারীর ওয়েসিস কফিনস এখন সফল এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিঃ এর অপারেশন ম্যানেজার জেমন্স এ খান জানালেন, ২০০৯ সালের জুন মাসে এই কো¤পানিটি এখানে কাজ শুরু করে। তিনি আরও বলেন, এ কো¤পানি সম্প্রসারণের জন্য আরও ২টি প্লট নেয়া হয়েছে।
এর বাইরেও জেলা সদরের লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নে একটি সাব-সেন্টার রয়েছে, সেখানে শ্রমিকরা বাঁশ প্রসেস করেন। এখানে শ্রমিক মালিক স¤পর্ক নেই, এখানে মালিকের সঙ্গে তাদের স¤পর্কটা পাটনারশিপ। সে কারণে প্রতি ৬ মাস অন্তর তারা বেতন-বোনাসের পাশাপাশি লভাংশও পেয়ে থাকেন।
কাঠের বদলে বাঁশ আর হোগলা দিয়ে কফিন তৈরি করার বিষয়ে তিনি বলেন, গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, এছাড়া একটি গাছ পরিপক্ব হতে সময় লাগে। গাছ নিধন করলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে আর বাঁশ ও হোগলা প্রতিবছরে হয় এবং এ অঞ্চলে এটা অনেক বেশি জন্মায়। কাঠের চেয়ে দামও তুলনামূলক অনেক সাশ্রয়ী। পণ্যের গুণগতমান ও নতুনত্ব থাকে। ওয়েসিস কফিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড হাউ বলেন, বাংলাদেশ অনেক ভাল দেশ, এখানকার মানুষরাও অনেক ভাল। ওয়েসিস কফিনস ফ্যাক্টারির নারী শ্রমিক সদর উপজেলার ইটাখোলা ইউনিয়নের কানিয়াল খাতা গ্রামের মতিন চন্দ্র রায়ের স্ত্রী রিনা রায় (৪০) বললেন, ৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। প্রথমদিকে একটু কষ্ট হলেও এখন কাজটা খুব সহজ হয়ে গেছে। এখানে ভারি কোন কাজ নেই, নেই তেমন কোন ঝুঁকি। স্বামীর আয়ে সংসারে অভাব-অনটন লেগে থাকত। অভাব-অনটনের কারণে ঝগড়া-বিবাদও হতো। এখন স্বামী এভারগ্রিনে কাজ করে আমি এখানে কাজ
করে মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করি। ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। আমাদের সংসারে এখন অভাবে বদলে সুখ। মোটরসাইকেল কিনেছি। স্বামী স্ত্রী দুইজনই এখন মোটরসাইকেলে যাওয়া আশা করি। আর আমরা যে কফিন তৈরি করছি এটা বিদেশে যাচ্ছে এটাও খুব আনন্দের বিষয়। শুধু রিনা রায় নয়, হাজার হাজার নারী-পুরুষ উত্তরা ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। এভারগ্রিনের পরচুলা কারখানার শ্রমিক জাহানারা বেগম (৩৫) জানালের ২০১২ সাল থেকে ইপিজেডের পরচুলা কারখানায় চাকরি করে ভালই আছি। আমাদের এখানে ইপিজেড না হলে পরের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতে হতো। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আজ আমরা এই ইপিজেডের মাধ্যমে নিজের ভাগ্যবদল করতে সক্ষম হয়েছি। স্বামী, ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার তৈরি হয়েছে। ভ্যানচালক আজিনুর ইসলাম (৩৫)। তার বাড়ি জেলা সদরের চড়াইখোলা ইউনিয়নের বেঙমারী গ্রামে। স্ত্রী কমলা বেগম ৫ বছর যাবত লেদার কারখানা ভেনচুরায় কাজ করছেন। প্রতিমাসে স্ত্রীর আয় হয় ১০-১২ হাজার টাকা। তার আয়ের চেয়েও স্ত্রীর আয় বেশি। প্রতিদিন ভোরে তিনি নিজের ভ্যানে স্ত্রীকে দিয়ে যান এবং বিকেলে নিতে আসেন। স্ত্রীকে কারখানায় আনা-নেয়ার সময় ওই এলাকার অন্য শ্রমিকেরাও আসেন তার ভ্যানরিক্সায়। এতে আজিনুরের প্রতিমাসে বাড়তি আয় হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। স্থানীয় ভাষায় এই ভ্যানচালক বললেন শেখ হাসিনা এই ইপিজেড বানায় দিছে। আর ইপিজেটের কারখানাগুলো হামার এইঠে কার মাইষিগুলার ভাগ্য বদলে দিছে।
বাংলাদেশ ইপিজেড কর্তৃপক্ষ (বেপজা) জানায়, উত্তরা ইপিজেডে বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এখানে উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্প প্লট ও কারখানা ভবনের ভাড়া ৫০ ভাগ কমানো হয়েছে। উত্তরা ইপিজেডের ব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার) এস এম আখতার আলম মোস্তাফি বলেন, এখানে বিনিয়োগকারীদের শতভাগ নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। তবে এই ইপিজেডে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ এলেই বিনিয়োগকারীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। তিনি জানান প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড হতে রফতানি হয়েছে ৯৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৯৯৫.৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সমমূল্যের নানা পণ্য। সব মিলিয়ে মন্দাভাব কাটিয়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড।