অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন

বীজ ফসল উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ভাল ফসলের জন্য ভাল বীজ প্রয়োজন। ফসল  উৎপাদনে ভাল বীজের গুরুত্ব অনুভব করে ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড গঠন করেন। এর পরপরই ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন ‘বীজ অনুমোদন সংস্থা’ তথা আজকের ‘বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি’। এছাড়া ১৯৭৩-৭৮ মেয়াদের বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় অনুমোদন করেন ‘দানাশস্য বীজ প্রকল্প’। এ সময় বিএডিসিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় ধান, পাট ও গমবীজ ফসলের বীজ উৎপাদনের জন্য। ফলে ১৯৭৪-৭৫ সাল হতে এ কার্যক্রমের আওতায় উন্নত জাতের মানসম্পন্ন প্রত্যয়িত বীজের উৎপাদন ও আমদানি বৃদ্ধি পায়।

যার জন্য ১৯৭৫ সালে শস্য উৎপাদন ৮৭ লক্ষ মেট্রিক টন থেকে  বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ মেট্রিক টনে, যা বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ, পরবর্তী বাংলাদেশে সার ও বীজ সংকটের ইতিহাস (১৯৭৫-১৯৯৫) অত্যন্ত দুঃখ্যজনক। এসময়, বিদেশি মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে বীজ আমদানী করতে হয়েছে যা এই সুজলা সূফলা এই দেশের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন কৃষিবান্ধব সরকার ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথমবার ও ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সফল ব্যবস্থাপনায় কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহনের ফলে বীজ খাতে অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বীজখাত আজ সুসংহত ও উন্নত। আর তাই সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত বীজ আজ কৃষকের দোরগোড়ায়। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মানসম্পন্ন বীজ উন্নয়নে বর্তমান সরকারের উল্যেখযোগ্য কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করা হলো।

নতুন বীজ আইন এবং বীজ বিধি প্রণয়ন

বীজের মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রনের জন্য শেখ হাসিনার সরকার বীজ আইন সংশোধন ১৯৯৭, বীজ বিধি ১৯৯৮ এবং বীজ আইন ২০১৮ প্রণয়ন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বীজ ফসলের সার্টিফিকেশনের সাথে সাথে বীজের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যবহারে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে এবং মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে গুনগত বীজ সময়মত সুলভ মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষদেরকে নির্দেশ প্রদান করেন।

বীজ উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্তকরণ

বর্তমান সরকার ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশের বীজ খাতে মৌলিক ও প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বাংলাদেশে বীজ উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, প্রত্যয়ন ও বাজারজাতকরণে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়। ফলস্বরুপ আজ প্রায় দশ হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শস্যফসলের বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে নিয়োজিত রয়েছে।

ব্রিডার বীজ সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম

১৯৯৬ সাল পর্যন্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্রিডার বীজ উৎপাদন ও প্রত্যয়নের সাথে জড়িত ছিল। ব্রিডার বীজের গুণগত মান বজায় রাখার স্বার্থে ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ বীজ বোর্ডের কাছে ব্রিডার বীজ প্রত্যয়নের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। যার ফলে, বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় পর্যায়ে বীজ উৎপাদনের এক নতুন অধ্যায় সূচনা হয়। বাংলাদেশে যা বর্তমানে কৃষিবান্ধব সরকারের অন্যতম সাফল্য।

ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা

কৃষকের দোরগোড়ায় বীজ পরীক্ষার সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারের নির্দেশে অত্যাধুনিক ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার ক্রয় করা হয়েছে। এই পরীক্ষাগার দেশের বিভিন্ন বিভাগ/ জেলায় গিয়ে মাত্র ত্রিশ টাকায় ধান, গম এবং পাট বীজের বিশুদ্ধতা অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা এবং আর্দ্রতা পরীক্ষার কাজ করে। বীজ পরীক্ষার ফলাফল সরাসরি মোবাইলে এসএমএস করে কৃষকদের জানিয়ে দেওয়া হয়। ফলে কৃষক বীজ বপনের পূর্বেই তার বীজের গুণ-মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে।

আধুনিক প্রত্যয়ন ট্যাগ প্রযুক্তি সংযোজন

সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে উৎপাদিত বীজের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য গাজীপুরের টাকশালে অত্যাধুনিক মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। সেখান হতে কঠোর নিরাপত্তায় বীজের মানঘোষিত প্রত্যয়ন ট্যাগ ছাপানো হয়। মেশিনের সাথে সংযুক্ত ইঙ্কজেট প্রিন্টার ব্যবহার করে ট্যাগগুলোর মূদ্রণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে আঞ্চলিক অফিসে সরবরাহ করা হয়। এসমস্ত আধুনিক ট্যাগসমূহে লুকানো একটি চিহ্ন রয়েছে যা খালি চোখে দেখা যায় না এবং নকল করা যায় না। যদি কেউ ট্যাগটি নকল করার চেষ্টা করে তবে তা সহজেই শনাক্ত করা যায়। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য বছরে বীজের চাহিদা প্রায় ১৩ লক্ষ মেট্রিক টন। বর্তমানে বাংলাদেশের বীজ শিল্প সরকারি এবং বেসরকারি খাত নিয়ে গঠিত। তাই সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে বিকাশের সাথে উচ্চগুণ সম্পন্ন বীজের সরবরাহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্তু, আমদানির উপর নির্ভরতা কমাতে এবং উচ্চমানের বীজ উৎপাদন করতে দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান গবেষণা কার্যক্রমের উপর জোর দিচ্ছে। সরকার বীজ আমদানীতে বেশ কিছু বিধিিনষেধ আরোপ করেছে এবং দেশীয় ভাবে উৎপাদিত বীজের জন্য বিভিন্ন ভর্তুকি প্রদান করছে। এরফলে বীজ উৎপাদনে খাতে ক্রমশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে দেশ অগ্রসর হচ্ছে। 

পরিশেষে বলা যায় ভাল বীজই কৃষির প্রাণ। তাই আজ মানসম্পন্ন বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধির ফলে নিশ্চিত হয়েছে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের কৃষিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। রুপান্তরিত হয়েছে খাদ্য আমদানিকারক থেকে রপ্তানিকারক দেশে। খাদ্য উৎপাদনে এই অভাবনীয় সাফল্য সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সুদূরপ্রসারী কৃষি বান্ধব নীতি মানসম্পন্ন বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার, কৃষি উপকরণের ভর্তুকি এবং সর্বোপরি কৃষি প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী করণের মাধ্যমে।

লেখক: পরিচালক, আইকিউএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।