প্রফেসর ড. আফ্জাল হোসেন
উপকূলীয় পর্যটন বলতে উপকূলীয় রেখা হতে ১৫০ কি.মি. পর্যন্ত ভূমি ও তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় জলসীমার মধ্যে পরিচালিত পর্যটনকে বোঝায়। সমুদ্রকেন্দ্রিক যে ৪ ধরনের পর্যটন (জলাভূমি পর্যটন, সৈকত পর্যটন, সমুদ্র পর্যটন ও উপকূলীয় পর্যটন) রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। কখনও কখনও এটিকে জলাভূমি পর্যটন ও সৈকত পর্যটনের সামগ্রিকরূপকেও বোঝায়।
বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলা এই পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এসকল জেলায় অবস্থিত পর্যটন শিল্প বিভিন্ন কারণে সমাদৃত যেমন-মৎস্য ও অন্যান্য জলজ সম্পদ, ম্যানগ্রোভ, ঝর্ণা, গ্যাস ও তেল, বালি ও খনিজ পদার্থ ইত্যাদি। তাছাড়া বাংলাদেশে রয়েছে ৫৮০ কি.মি. উপকূল জুড়ে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত যার মধ্যে কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন অন্যতম। তবে এসকল পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি বাকি জেলাগুলোতে পর্যটন আকর্ষণ সমৃদ্ধ নয়।
একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পণ্য ও সেবা খাত উভয়ের ভূমিকা অপরিহার্য। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি’তে ৫২% সেবা খাত থেকে আসছে যার একটি অন্যতম খাত পর্যটনশিল্প। এই শিল্পকে যুগোপযোগী ও আকৃষ্ট করতে বর্তমান সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যার উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের একটি অংশকেই এই লেখাতে উপস্থাপন করা হলো।
দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার মধ্যে ১৩টি দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত যার অভূতপূর্ণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ মেগা প্রকল্প পদ্মা বহুমূখী সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে। এর ফলে ঢাকা থেকে সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটায় নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত ব্যবস্থা (পদ্মা সেতু-শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতু-পায়রা সেতু-শেখ কামাল সেতু-শেখ জামাল সেতু-শেখ রাসেল সেতু) তৈরি হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এমনকি এই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে একটি উপকূলীয় জেলা-শরীয়তপুর পরিচিতি পাচ্ছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। শরীয়তপুরের নড়িয়ায় দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষিত বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে একদিকে যেমন রক্ষা পেয়েছে অত্র অঞ্চলের পৈত্রিক ভিটে-সম্পত্তি তথা নড়িয়া উপজেলার অস্তিত্ব, অন্যদিকে অত্র অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র। পড়ন্ত বিকেলে পদ্মা পাড়ের উন্মুক্ত পরিবেশ এবং নয়নাভিরাম দৃশ্য যেন মন কেড়ে নেয় দর্শনার্থীদের। উপরন্তু, নড়িয়ায় ইতোমধ্যে জয় বাংলা এভিনিউ ও নড়িয়ার বেড়িবাঁধ পর্যটকদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে।
তাছাড়া শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা ও মাদারীপুরের শিবচর এলাকায় নির্মিত হতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় তাঁতশিল্প ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি’ যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে তৈরি হতে যাচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। একইসাথে পদ্মা সেতুকে ঘিরে তৈরি হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে যা ঢাকা প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটারকে সংযুক্ত করেছে। এর ফলে মাওয়া প্রান্তে (শরীয়তপুরের জাজিরা) গড়ে ওঠেছে পর্যটকদের জন্য এক নতুন মাত্রা।
প্রতিদিন বিকেলে শত-শত মানুষের সমাগম হওয়ায় এ এলাকাকে নতুন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনায় আনতে পারে সরকার। যদিও ইতোমধ্যে অত্র অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে শেখ রাসেল সেনানিবাস ও জাজিরা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলে দেশের অত্র অঞ্চলসমূহের মানুষের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এমনকি পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের বণ্টন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত ও সহজলভ্য হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে আধুনিক, নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে যে ধারাবাহিক প্রকল্প গ্রহণ করেছেন তারই ছোঁয়া দক্ষিণাঞ্চলে দৃশ্যমান হয় এবং এর প্রভাব পর্যটন খাতে ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে।
তাছাড়া বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে কুয়াকাটা ও সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশেও গুরুত্বারোপ করেছে। নির্মিত হয়েছে কুয়াকাটা বেড়িবাঁধ। একইসাথে, বঙ্গোপসাগরের জলাভূমি এলাকাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে তুলতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে এ সকল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে একটি স্থিতিশীল ও ধারাবাহিক সরকারের বিকল্প নেই।
উপরন্তু, এ সকল পর্যটন বিকাশে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারকে আরও বেশি মনোনিবেশ প্রদান করতে হবে। তাহলেই পর্যটন শিল্পের বিকাশ আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে। এক্ষেত্রে, পর্যটন শিল্প বিকাশে বিভিন্ন ধরণের সেবাকেন্দ্রিক সুবিধাসমূহ প্রদানে ভূমিকা পালন করতে হবে; যেমন, সু-স্বাস্থ্যকর পণ্য/ সেবা বিক্রয় যার মধ্যে খাদ্য-আবাসন অন্তর্ভুক্ত, সঠিক মূল্য প্রাপ্তিতে নিশ্চয়তা, তথ্য প্রাপ্তিতে সহজলভ্যতা, ক্রয় প্রসারকে ত্বরান্বিত করা ইত্যাদি।
লেখক: প্রফেসর, মার্কেটিং বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।