বিশেষ প্রতিবেদক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইউএনও এবং ওসিদের বদলির আদেশের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ উঠলে ডিসি এসপিদের বদলি করা হবে বলেও জানিয়েছে কমিশন। এছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে শোকজ করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুস্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে ইসি, যা ইতিবাচক।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের অনুমতির জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে গত রোববার চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ। দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ওই দিন বিকেল ৩টায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট সংলগ্ন রাস্তায় সমাবেশ আয়োজন করবে। সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তবে আওয়ামী লীগের ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের অনুমতি দেয়নি নির্বাচন কমিশন। বাধ্য হয়ে সমাবেশ বাতিল করেছে ক্ষমতাসীন দল। মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস। এই মানবাধিকার দিবসে আমরা বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে একটি বড় সমাবেশ করব, এরকম একটা কর্মসূচি আমাদের ছিল। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছিলাম। সে আবেদন তারা গ্রহণ করেননি। বাইরে সমাবেশের নামের শোডাউন হবে সে আশঙ্কা করছে। যে সমাবেশ করার কথা সেটি করছি না। নির্বাচনি বিধির বাইরে আওয়ামী লীগ যাবেনা বলেও জানান ক্ষমতাসীন দলের এই সাধারণ সম্পাদক।

এর আগে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকেও শোকজ করেছে নির্বাচন কমিশন। চার মন্ত্রী হলেন- নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের প্রার্থী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী; গাজীপুর-২ আসনের প্রার্থী, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল; ঢাকা-১৯ আসনের প্রার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান; নাটোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। শোকজের তালিকা থেকে বাদ যাননি সংসদ সদস্যসহ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়া অধিকাংশ প্রার্থীই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।

এছাড়া দেশের সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) এবং সব উপজেলা নির্বাহী অফিসারকেও (ইউএনও) পর্যায়ক্রমে বদলির নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বদলির প্রথম ধাপে ওসিদের বেলায় বর্তমান কর্মস্থলে চাকরির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় মাস, আর ইউএনওদের বেলায় তা করা হয়েছে এক বছর। অর্থাৎ একই উপজেলায় যারা এক বছর কিংবা এর বেশি সময় ধরে নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন, প্রথম ধাপে তাদের বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইসির নির্দেশের ধাপে ধাপে ইউএনও এবং ওসিদের বদলি শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর। ইসির নির্দেশনা মেনে ইউএনওদের তালিকাও করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তালিকায় থাকা ২০৭ ইউএনওর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪৯, ময়মনসিংহে ১৫, বরিশালে ১২, সিলেটে ২১, রংপুরে ১৭, রাজশাহীতে ২৭, চট্টগ্রামে ৪৮ ও খুলনা বিভাগে ১৮ জন রয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর ৩২৬ জন ওসির তালিকা করেছে। এরমধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩ জন, ঢাকা রেঞ্জে ৬০ জন, সিলেট রেঞ্জে ২০ জন, রংপুর রেঞ্জে ২৮ জন, বরিশাল রেঞ্জে ২১ জন, খুলনা রেঞ্জে ৩৮ জন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে তিন জন, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ২৩ জন, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে চার জন এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পাঁচ জন রয়েছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে প্রয়োজনে ডিসি এসপিদের বদলি করা হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) বদলির কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দুই জেলা প্রশাসককে বদলি করা হয়েছে। এরপর যখন যেখানে ডিসি-এসপি বদলির দরকার হবে, আমরা তা করব।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। আমিও এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। সরকার কখনও নির্বাচন কমিশনের কোনো কাজে বাধা দেয়নি, বরং সহযোগিতা করেছে। এবারের নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে কমিশন। ইউএনও এবং ওসিদের বদলির কারণে প্রশাসন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হবে।’ সরকারি দলের সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে কমিশন সবচেয়ে বড় নিরপেক্ষতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বলেও মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে কমিশনের পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। প্রশাসনের রদবদল নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সহায়ক হবে।’ এই রদবদল নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও কমিশনের নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মত দেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় অনেক প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। আমি ভেবেছিলাম, সেদিকে হয়তো নজর দিতে পারবেনা কমিশন। কিন্তু তারা সেখানেও পদক্ষেপ নিয়েছে।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় গত ১৫ নভেম্বর। আর নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে। আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ভোট।